রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৭:৩৭ অপরাহ্ন

কী কারণে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ?

ভারতের ওড়িশা রাজ্যের বাহানগর বাজার স্টেশনে তিনটি ট্রেন পাশাপাশি পড়ে আছে ধ্বংসস্তুপ আকারে। ট্রেনের যাত্রীদের পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছেন। প্রিয়জনের মরদেহ খোঁজার জন্য তাদের আকুতি পরিবেশ ভারী করে তুলেছে। উদ্ধারকর্মীদের ভ্যান কিংবা অন্যান্য যানে বিকৃত মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে অনেকেই তার প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্ত করার আকুতি জানাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেকে হাসপাতালে ভিড় করছেন। কারণ উদ্ধারকর্মীরা অনেককে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেখানেও মানুষের আর্তি আর কান্নার শব্দ। এত খোঁজাখুঁজির পরও প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শনাক্ত করার জটিলতা সমস্যা তৈরি করেছে। দৃশ্যটা কত ভয়াবহ একবার কল্পনা করা যাক, স্থানের অভাবে লাশ অনেকটা স্তুপ করে রাখা হয়েছে। নিষ্প্রাণ মানুষের স্তুপে কেউ পরিচিতের মুখ খুঁজে পান না। এমন অসহায়ত্ব কত বড় বীভৎস ও মর্মন্তুদ পরিণতির পরিচয় দেয়, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকর্মীরা তৎপর হয়ে ওঠেন। তাদের প্রধান কাজ ছিল লাশ উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া। হাসপাতালেও লাশ ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা বাহানাগার উচ্চ বিদ্যালয়কে সাময়িক সময়ের জন্য মর্গ বানানো হয়। সেখানে শত শত লাশ রাখা হয়। দায়িত্বশীলরা অপেক্ষা করছেন, তাদের আত্মীয়স্বজন এসে শনাক্ত করে নিয়ে যাবেন। পার্শ্ববর্তী শিল্প এলাকায় আরেকটি মর্গের ব্যবস্থার কথাও জানা গেছে। স্কুলে মানুষের ভিড় ক্রমেই বাড়ছিল। প্রচন্ড তাড়াহুড়োয় তারা এক মরদেহ থেকে অন্য মরদেহ পর্যবেক্ষণ করছিল। চেষ্টা করছিল প্রিয়জনকে এই স্তুপ থেকে খুঁজে বের করার। রাষ্ট্রীয় সংস্থার দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানান, তখন পর্যন্ত ২০০ লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

এ অবস্থায় লাশের পরিচয় শনাক্ত করাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কারণ লাশ শনাক্ত করার জন্য আত্মীয় স্বজনদের প্রথমে প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। তারপর মরদেহ অটোপসি করা হবে এবং লাশ হস্তান্তর করা হবে। যদি কেউ স্বজনের লাশ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন তাহলে ডিএনএ টেস্ট কিংবা অন্যান্য পরীক্ষা পদ্ধতির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হব। একটি দুর্ঘটনার প্রভাব জাতীয় জীবনে কেমন হতে পারে তার সবচেয়ে বড় নজির এই ট্রেন দুর্ঘটনা। ভুল সিগন্যালে কতগুলো প্রাণ ঝরে পড়ল। যেখানে এতগুলো মানুষের জীবন জড়িত সেখানে এমন একটি ভুল মেনে নেওয়ার মতো নয়। যারা স্কুলে মরদেহ শনাক্ত করতে গেছেন তারা সেখানকার বীভৎস দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা অনেকেই জায়গাটিকে নরক বলে উল্লেখ করছেন। স্কুলের সংকীর্ণ একটা ঘরে লাশ স্তুপ করে রাখলে এই দৃশ্য ভালো লাগার কথা নয়।

দুর্ঘটনা থেকে যাদের জীবিত উদ্ধার করা হয় তাদের কাছে ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া গেছে। অন্তত ১৭টি বগি একসঙ্গে লাইনচ্যুত হয়। জীবিত একজনের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বীভৎসতার খানিক আন্দাজ পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনার সময় তিনি বগিতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলেন। আচমকা কোলাহল আর নড়াচড়ায় তার ঘুম ভেঙে যায়। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্তত ১০-১৫ জন মানুষ তার ওপর এসে পড়ে। ওই সময় হাত এবং ঘাড়ে তিনি প্রচন্ড ব্যথা পান।

সৌভাগ্যবশত তিনি ট্রেন থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। বের হওয়ার পর আশপাশে ছিন্ন হাত ও পা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিছু মরদেহও তার চোখে পড়ে। কারও চেহারাই আর শনাক্ত করার মতো অবস্থায় নেই। দুর্ঘটনার সময় ট্রেনের বগিতে মানুষের চিৎকার এক সময় আহাজারিতে পরিণত হয়। যারা সৌভাগ্যবশত বেঁচে ফিরেছেন তাদের অনেকেই মানসিকভাবে ভারসাম্যহীনের মতো আচরণ করছেন। ভারতে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া নিয়ে ২০২২ সালে দ্য কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া (ক্যাগ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে দেশটির রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিভিন্ন ত্রুটি থাকার তথ্য উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা এড়াতে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর প্রতিবেদনটির প্রসঙ্গ আবারও সামনে এসেছে।

ভারতের সরকারি রেলওয়ে সেফটি রিপোর্ট ২০১৯-২০-এর তথ্যগুলো সামনে নিয়ে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারতে রেল দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশ ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার কারণে ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি। এর পরের দুটি কারণ হচ্ছে, ট্রেনে অগ্নিকান্ড এবং সংঘর্ষ, যা যথাক্রমে মোট দুর্ঘটনার ১৪ শতাংশ এবং আট শতাংশ। ওই সময়ে লাইনচ্যুত হওয়া ৪০টি ট্রেনের মধ্যে ৩৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন এবং সাতটি মালবাহী ট্রেন। এর মধ্যে ১৭টি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে রেললাইনে ত্রুটি থাকার কারণে, যার মধ্যে ফাটল এবং রেললাইনের সংকোচন-প্রশমন দুটি বড় কারণ। ভারতের ওড়িশায় রেল দুর্ঘটনার পর নতুন করে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। দেখার বিষয়, এক্ষেত্রে পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আপাতত এই মর্মন্তুদ ঘটনার বিরূপ প্রভাব সামাল দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু এর পরিসংখ্যানগত দিক এড়িয়ে যাওয়ার নয়। এখন সাহায্যের বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Titans It Solution