শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৩১ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক:: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২৪ সালের মার্চ মাসে। ‘বিতর্কিত’ ওই নির্বাচনে সভাপতিসহ চারটি পদে বিএনপির আইনজীবীরা নির্বাচিত হন। সম্পাদকসহ ১০টি পদে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
একই বছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামীপন্থি আইনজীবী নেতারা সুপ্রিম কোর্টে আসা বন্ধ করে দেন। এ সময় সাময়িক সময়ের জন্য সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের নেতৃত্ব অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হয়। ২০২৫ সালের মার্চ আগেই তাদের সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এডহক কমিটি দিয়ে চলছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। সর্বোচ্চ আদালতের অধিকাংশ আইনজীবী বিষয়টা ভালোভাবে নিচ্ছেন না।
ডাকসু নির্বাচনের পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়ে উঠেছেন আইনজীবীরা। নির্বাচনের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে পোস্ট দিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরাও দ্রুত সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। অনেক আইনজীবী অভিযোগ করেছেন, এডহক কমিটি অদৃশ্য কারণে নির্বাচন দিচ্ছেন না। সব আইনজীবী নির্বাচনের দাবি করলেও তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, গত ৬ মে আমি সুপ্রিম কোর্ট বারের এডহক কমিটিকে লিখিতভাবে বলেছি, অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট বারের গণতান্ত্রিক চরিত্র ব্যাহত হচ্ছে। সাধারণ আইনজীবীদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এই সুপ্রিম কোর্ট বারে সুষ্ঠু ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা লড়াই সংগ্রাম করেছি। গত সপ্তাহেও আমাদের আইনজীবীদের দলীয় ফোরামে সুপ্রিম কোর্ট বারে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছি।
ব্যারিস্টার কাজল বলেন, এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে চাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আইনজীবীদের একটি তলবি সভার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট বারের এডহক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সভাপতি ও আমাকে সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইনজীবীদের মতামতের প্রতি সম্মান থাকলে আমি অনির্বাচিত কোনো কমিটির সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করতে চাইনি। একারণে এডহক কমিটিতে কোনো দায়িত্ব নিইনি। সবশেষে বলব, দ্রুত সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচন হওয়া দরকার। বেশ কয়েকটি জেলা বারে ইতোমধ্যে নির্বাচন হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এখানে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকা বেশি প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন নিয়ে মাঝখানে আলোচনা হয়েছিল। তারপর আর কোনো আপডেট তথ্য আমরা পাইনি। আশাকরি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনের নিয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, আমি মনে করি সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন হওয়া দরকার। সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনের তারিখ কেন ঘোষণা করা হচ্ছে না, বর্তমানে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, সেই এডহক কমিটিই বলতে পারবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি গত ১৬ বছর আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছি। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী গুম হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জেল খেটেছে।
তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বারে আইনজীবীদের ভোটের অধিকারের জন্য আমরা গত ৪ বছর লড়াই সংগ্রাম করেছি। মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে অনেকেই কারাগারে গিয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বারে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য তৎকালীন সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলকে কারাগারে যেতে হয়েছে। সুতরাং, আমরা মনে করি সুপ্রিম কোর্ট বারে অবশ্যই নির্বাচন হওয়া উচিত। সুপ্রিম কোর্ট বারকে অনুসরণ করে সারাদেশে যতগুলো বার আছে সে বারগুলোতে নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন কেন হচ্ছে না, এর উত্তরটা এডহক কমিটি দিতে পারবেন। তবে আমি চাই খুব শিগগিরই সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন হোক।
সুপ্রিম কোর্ট বারে একাধিকবার সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছেন অ্যাডভোকেট ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া। তিনি দ্রুত নির্বাচন চান। সুপ্রিম কোর্ট বারে আইনজীবীদের ভোটের অধিকার ফেরত চান।
অ্যাডভোকেট ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য যে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন বিগত কয়েক বছরে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়নি। চর দখলের মত যে যেভাবে পেরেছে সেইভাবেই সমিতির চেয়ার দখল করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অতীতের ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত করেছে। আমি একটা জিনিস বুঝি না কি মধু আছে এখানে? যেই ক্ষমতায় আসে জোর জবরদস্তি করে চর দখল করে রাখতে চায়।
এডহক কমিটিকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, নৈতিকতার মানদণ্ডে আপনারা কী বিচার করেছেন, কোন কর্তৃত্ববলে কাদের ভোটে আপনারা এখনো লাম-সাম রেজুলেশন করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন না দিয়ে লাভজনক পদের মত সমিতির পদ পদবি দখল করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত আছেন? নির্বাচন না দেওয়ার পেছনে এত ভয় কেন? একবার মিটিং করে বললেন রোজার পরে নির্বাচন দেবেন, রোজার পরে আবার মিটিং করলেন বললেন ইমিডিয়েট নির্বাচন দেবেন; তারপর ভোটার তালিকা হালনাগাদ হলো। অদৃশ্য কারণে একটি মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলেন নির্বাচন এখন দেবেন না। নির্বাচন দিলে হয়ত আপনাদের সিনিয়র ব্রিফ কমে যাবে, কারণ পদে থেকে অনেক কিছুই করা যায়।
তিনি আরও বলেন, আপনারা দেশের বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন জাতীয় নির্বাচন খুব দ্রুত দিতে হবে এটা বলছেন, ঠিক আছে। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবীদের ভোট দেওয়ার অধিকারকে আপনারা কেড়ে নিয়েছেন। সাধারণ বিজ্ঞ আইনজীবীরা এই বিষয়টা অবশ্যই মনে রাখবে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে হেরে যাবেন বলেই কি নির্বাচন পিছিয়ে দিচ্ছেন এমন প্রশ্ন বিজ্ঞ আইনজীবীদের মনে জাগতেই পারে। যাই হোক, আমি যেটি বলতে চাচ্ছি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অতীত ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলে সবার জন্যই কল্যাণকর। আমি মনে করি সংশ্লিষ্টরা খুব দ্রুতই বারের নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন নবনির্বাচিতদের কাছে। বারের কোনো বাজেট নেই, অডিট নেই, আপনারা ইচ্ছেমতো বারে টাকা খরচ করতে পারেন না।
সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন নিয়ে মতামত জানতে এডহক কমিটির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলনকে ফোন করলে দেশের বাইরে থাকায় তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে কিছুদিন আগে বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের বারের নির্বাচন আমরাও দিতে চাই। চারিদিকে এখনও মব কালচার শেষ হয়নি। এ অবস্থায় নির্বাচন দেওয়াটা সমীচীন হবে না বলে অনেকে মনে করছেন।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১০ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হন বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হক।
নির্বাচনের ৪৪ ঘণ্টা পর গত বছরের ৯ মার্চ বিকেল ৩টার পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়। ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনায় আগেরদিন ৮ মার্চ রাজধানীর শাহবাগ থানায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়। হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা ওই মামলায় আরও ৩০-৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এরপর ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যান সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তছনছ হয়ে যায় আওয়ামী সরকারের সব কিছুই। এমন বাস্তবতার প্রভাব পড়ে সুপ্রিম কোর্ট বারেও। এরপর বিশেষ সাধারণ সভা করে গঠন করা হয় বারের অ্যাডহক কমিটি। সেই কমিটি দিয়েই চলছে সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের এ সংগঠনটি।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা পালানোর পর নির্বাচন না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (সুপ্রিম কোর্ট বার) অন্তর্বর্তী কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। বারের বর্তমান সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে অন্তর্বর্তী কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি এবং সমিতির ২০২৪-২৫ বর্ষের জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুসকে (কাজল) সম্পাদক করা হয়েছে। পরে রুহুল কুদ্দুস কাজল দায়িত্ব গ্রহণ না করায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।