শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১৯ অপরাহ্ন
ফাইল ছবি অনলাইন ডেস্ক:: ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পরম্পরা বিশ্লেষণ এবং দিন দিন সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই বিষেশজ্ঞরা বাংলাদেশে বড় মাত্রার (৮ মাত্রার) ভূমিকম্পের শঙ্কা করছেন ভূ-তত্ত্ববিদরা। বাংলাদেশকে ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিচ্ছে।
গতকাল শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পন জানান দিয়েছে বাংলাদেশ কতটা ভুমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
অন্যদিকে নির্মাণবিধি মেনে ভবন তৈরি না করায় বাংলাদেশের অনেক ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। এতে বহু হতাহতের শঙ্কাও করছে সংস্থাটি।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বাংলাদেশেও মিয়ানমারের (৭ দশমিক ৭ মাত্রা) মতো একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বড় মাত্রার ভূমিকম্পন হলে সারা দেশে ৬ কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কার কথা বলা হয়েছে খোদ দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে।
৮ মাত্রার ভূকম্পনের শঙ্কা কেন?
বাংলাদেশ এবং এর আশপাশে ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাসকে আরো কাছে এনেছে। ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের পরম্পরা বিশ্লেষণ এবং দিন দিন সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই বিষেশজ্ঞরা বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা করছেন ভূতত্ত্ববিদরা। ঐতিহাসিক ভূমিকম্পের মাত্রাগত পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের দুই ধরনের ভূমিকম্পের কথা বলছেন তারা। এক ধরনের ভূমিকম্প হলো রিখটার স্কেলে ৮ বা এর চেয়ে বেশি। আরেক ধরনের হলো ৭ বা এর চেয়ে বেশি।
ভূতত্ত্ববিদ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হয়, তার মধ্যে সাধারণত ৮ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর ফিরে আসে। আর ৭ বা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ১২৫ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে ফিরে আসে। বাংলাদেশ বা এই ভূখণ্ডে বড় ভূমিকম্পের মধ্যে আছে ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এটি ‘গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এর ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার। ১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রায় এবং ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব জরিপ ও গবেষণা সংস্থা ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, চলতি বছর (২৮ মার্চ ) মিয়ানমারে ৭ দশমিক ৭ এবং ৬ দশমিক ৪ মাত্রার দু’টি ভূমিকম্প হয়। দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় শহর সাগাইংয়ে ভূপৃষ্ঠের ১৬ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূকম্পটির উৎপত্তিস্থল। এর প্রভাব মিয়ানমারের প্রতিবেশী থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশেও পৌঁছেছিল। এই ভূমিকম্পের ফলে মিয়ানমারে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং থাইল্যান্ডসহ প্রতিবেশী দেশগুলোও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও বাংলাদেশের তেমন ক্ষতি হয়নি।
গতকাল ১০টা ২৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ড থেকে বাংলাদেশের মধ্যে নরসিংদীর মাধবদী থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। যার মাটির ১০ কিলোমিটার গভীর থেকে আসে। এতে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ছয় নিহত এবং শতাধিক আহত হন।
এই হতাহত ও আতঙ্কের ঘটনাকে বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আলামত হিসেবে দেখছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি জানান, ভূমিকম্পের যে রিটার্ন পিরিয়ড একশ বা দেড়শ বছর, আমরা (বাংলাদেশ) তার খুব কাছাকাছি আছি। বাংলাদেশে যে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আছে সেটা স্পষ্ট হয়েছে গত কয়েক বছরে ছোট ও মাঝারি মানের বহুবার ভূমিকম্প হয়েছে। শুক্রবারের ভূমিকম্পটি একটা বড় ভূমিকম্পের আলামত। ঢাকার ঝুঁকিটা অনেক বেশি। এই শহরের ভবনগুলোর মান অত্যন্ত দুর্বল। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনেক বেশি।
বড় ভূমিকম্পের শঙ্কার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, কাঠের টুকরার দুই পাশে যদি ক্রমাগত চাপ দেয়া হয়, তবে এর ভেতরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। একসময় উভয়মুখী চাপে কাঠটি চিড়ে যেতে পারে। এক সময় টুকরাটা ভেতরে তৈরি হওয়া শক্তির চাপে ফেটে যাবে। বাংলাদেশের আশপাশে যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে, সেটা এখন কাঠের চিড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় আছে।
ভূতত্ত্ববিদ ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার আরো বলেন, গেল কয়েক শ’ বছরের ইতিহাসে এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত এলাকায় বিগত ৪০০ থেকে হাজার বছরের ইতিহাসে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। ফলে এসব স্থানে ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার মতো অতি শক্তি জমা হয়ে আছে। ফলে সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৮ মাত্রারও বেশি ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি জমা আছে। যেকোনো সময় সে শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। এই শক্তি একবারে বের হতে পারে। ধাপে ধাপেও বের হতে পারে। এতে সিলেট ও চট্টগ্রাম ছাড়াও সব থেকে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: জিল্লুর রহমান বলেন, মিয়ানমান বা নেপালের মতো অত বেশি ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকি আমাদের নেই। ওদের ওখানে সর্বশেষ ১৯৪৬ সালে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ফলে ৮০ বছরের মধ্যে সেখানে আবারো বড় ভূমিকম্প হয়ে গেল। আমাদের এখানে কিন্তু সর্বশেষ ১৯১৮ সালে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। এক শ’ বছরের বেশি হয়ে গেছে। এখানে দেড় শ’ বা ২০০ বছর পরপর ওই ধরনের ভূমিকম্প হয়। সে হিসাবে আমরাও ঝুকির মধ্যে আছি। আমাদের প্রস্তুতি রাখতে হবে। এ বিষয়ে গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, যেকোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার একটি সময় হয়ে গেছে। তবে বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
মিয়ানমারের ভূমিকম্পের পরের দিন (২৯ মার্চ ২০২৫) ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিভেন্স অধিদফতর প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, বড়মাত্রার ভূকম্পন ঝুঁকিতে আছে দেশ। মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশেও একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভূমিকম্প মোকাবেলার জন্য সকল পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে।
বড় ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা: বাংলাদেশে যদিও এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে বড় মাত্রার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। শুধু শুক্রবারের ভূমিকম্পেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভূকম্পনের তেমন কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা না থাকায় শঙ্কা উদ্বেগ বাড়ছে।
খোদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বড়মাত্রার ভূকম্পন হলে কি ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। মন্ত্রণালয়টি থেকে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) একটি প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে যদি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে সারা দেশে ৬ কোটি ১২ লাখ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়বে। ১১ লাখ ৯ হাজার পাকা ভবন, ২১ লাখ ১৪ হাজার সেমিপাকা স্থাপনা, ৪০২টি খাদ্যগুদাম, ১৪টি গ্যাসফিল্ড, ১৯৫টি হাসপাতাল। এক হাজার আটটি কল্যাণকেন্দ্র, দুই হাজার ৮০০ উচ্চবিদ্যালয়, এক হাজার ৯০০ মাদ্রাসা, ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছয় হাজার ৮০০ পুলিশ স্টেশন, এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, সাত হাজার ৪০০ কিলোমিটার স্থানীয় সড়ক, ২০ হাজার ব্রিজ, এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে যে ভূমিকম্প মোকাবেলায় প্রস্তুতির অভাব রয়েছে তাও স্বীকার করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পে যদি রাজধানীর এক শতাংশ বিল্ডিং ধসে পড়ে তাহলে তিন লাখ মানুষ হতাহত হবেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থেকে আরো অনেকের মৃত্যু হবে। এ অবস্থায় ভূমিকম্প সহনীয় নিরাপদ অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি নিয়মিত মহড়া ও সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ এসেছে বিশেষজ্ঞদের কাছে থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: জিল্লুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি, প্রস্তুতি নিতে হবে। নতুন ভবনগুলো কোড মেনে বানাতে হবে। আর পুরানগুলো সার্ভে করে যেগুলো একেবারেই দুর্বল সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। আর যেগুলোর স্টেন বাড়ানো সম্ভব সেটা করতে হবে। আমাদের আরো বেশি প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের এখানে যদি থাইল্যান্ড বা মিয়ানমারের মতো ওই মাত্রায় ভূমিকম্প হয় তাহলে অবস্থা হবে ভয়াবহ। কারণ এখানে এত ঘনবসতি যা আর কোথাও নেই। ওদের ওখানে তো লোকসংখ্যা কম। বিল্ডিংও এত ঘন ঘন না। আমাদের এখানে রাস্তাগুলো এত ছোট যে সেখানে উদ্ধারকারী যানবাহনগুলোই যেতে পারবে না।
বড় মাত্রার ভূকম্পন হলে ক্ষয়ক্ষতি কি হতে পারে এ নিয়ে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট: রাজউক অংশ শিরোনামে প্রকল্পের মাধ্যমে গত বছর (২০২৪) একটি গবেষণা হয়েছে। এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য মতে, বাংলাদেশ ভূকম্পনের সক্রিয় এলাকায় অবস্থিত। দুর্যোগ সূচক অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোটখাটো কম্পন দেশের আরো শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা নির্দেশ করে।
ভূতত্ত্ববিদ ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞারা জানান, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। এসব ভূমিকম্পের মধ্যে মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পও রয়েছে। মিয়ানমারের ভূমিকম্পনটি যদি বাংলাদেশ মুখী প্লেটে ঘটতো তাহলে এর ক্ষতিটা হতো খুবই ভয়াবহ। কারণ বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে সুবিশাল ফল্ট থাকায় একটি দেশে ভূমিকম্প হলে তার পার্শ্ববর্তী দেশে যেকোনো মুহূর্তে বড় ভূমিকম্প হতে পারে এমন শঙ্কা থেকে যায়। অভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশে এই ভূমিকম্প প্রমাণ করে বাংলাদেশ বড় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে।
অনুসন্ধান বলছে, ভূমিকম্পের সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে আছে নিম্নবিত্তরা। কারণ বিত্তবানরা যেসব ভবনে থাকেন সেগুলো কিছুটা ভালোভাবে তৈরি করা। সেগুলোতে ঝুঁকি কম। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ যেসব ভবনে থাকেন সেগুলোতে ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ অনেক ভবন জলাশয় বন্ধ করে তৈরি করা হয়েছে। এই ভবনগুলো এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। আর কোনো কারণে ভূমিকম্প হিট করলে রাস্তাগুলো এত ছোট যে সেখানে উদ্ধারকারী যানবাহনগুলোই যেতে পারবে না। ফলে ঝুঁকিটা অনেক বেশি।
মিয়ানমারের (২৮ মার্চের) ভূকম্পনের পর বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানিয়েছিল, ভূমিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরান ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সব বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস আরো জানায়, ইউটিলিটি সার্ভিসসমূহ যথা- গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের সঠিকতা নিশ্চিত করতে হবে। ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পর্যায়ে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত মহড়া অনুশীলন ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নাম্বারগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সব ভবন বা স্থাপনায় সংরক্ষণ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখতে হবে। ভলান্টিয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দুর্যোগকালীন সময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা।
ফায়ার সার্ভিস আরো জানায়, ‘জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি যেমন- টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ), বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট/কুশন, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী, ফার্স্ট এইড বক্স, শিশু যতেœর সামগ্রী ইত্যাদি বাসাবাড়িতে নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণ করা যাতে ভূমিকম্প পরবর্তীতে আটকা পরলে তা ব্যবহার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায়। সব পর্যায়ে তদারকি সংস্থার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশ অত্যান্ত জনবহুল এলাকা। এখানবার রাস্তাঘাটগুলো খুবই সরু। আমরা যদি থাইল্যান্ড বা মিয়ানমারের সাথে তুলনা করি তাহলে এমন একটি ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে তার ক্ষয়ক্ষতি হবে ব্যাপক। ভূমিকম্পের দুই ধরনের প্রস্তুতি আছে। একটা হলো- আমাদের জরুরি মুহূর্তে রেসপন্স করার ক্ষেত্রে কতটুকু প্রস্তুত আছি এবং আরেকটা হলো- আমাদের স্থাপনাগুলোকে দুর্যোগ সহনশীল করতে হবে। আর আমাদের প্রস্তুতিরও ঘাটতি আছে। এই কারণে যে, আমরা কিন্তু এই ধরনের দুর্যোগ এখনো মোকাবেলা করিনি। ফলে এটা নিয়ে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা কিন্তু এগুলো থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না। কোন একটা ঘটনা ঘটলে আমরা নড়েচড়ে বসি, কয়েকদিন পর সবাই ভুলে যান। আমাদের এখানে রাস্তাগুলো এত সরু যে, একটা অ্যাম্বুলেন্সও যেতে পারে না, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাবে কিভাবে? এক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্টও দুর্বল। একটা টাস্কফোর্স করা খুবই জরুরি কাজগুলোর সমন্বয়ের জন্য। সেটাও হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সব পক্ষের গাফিলতি আমরা দেখি।
আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত দেশে ছয়টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল। দুই মাস পর ২১ নভেম্বর আবারো ভূকম্পন অনুভূত হলো। যার মাত্রা মাঝারি। অন্যদিকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশগুলোতে ৫৩টি ভূমিকম্প হয়। এ ছাড়াও ২০২৩ সালে ৪১টি এবং ২০১৭ সালে ভূমিকম্প হয় বাংলাদেশে।
মোকাবেলায় নেই প্রস্তুতি: সাইক্লোনের আগাম প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশ একটা অন্যতম দেশ। সাইক্লোনের তিন দিন আগে একটা বার্তা পাওয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্প কোন বার্তা দেয় না। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি ততটা না। ভূমিকম্পে যেটা বলা হয়, প্রস্তুতির চেয়ে ভবনকে শক্তিশালী করাটাই বেশি প্রয়োজন। ৯০ শতাংশ মানুষকে বাঁচানো সম্ভব যদি ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল হয়। বাকি ১০ শতাংশের জন্য প্রয়োজন উদ্ধার তৎপরতা। আর তার জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি। বাংলাদেশ সরকার ৪০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছে। এগুলো ফায়ার সার্ভিস ও আর্মিকে দেয়া হয়েছে। এগুলোও যথেষ্ট না। প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে কমিউনিটি ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবকও তৈরি করা দরকার। রানা প্লাজার ঘটনা যখন ঘটে তখন ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষকে কিন্তু উদ্ধার করেছে স্বেচ্ছাসেবকরা। বাকিটা ফায়ার সার্ভিস করেছে। উদ্ধার প্রক্রিয়ার ট্রেনিং আমাদের ফায়ার সার্ভিসের আছে। যন্ত্রপাতি থাকলো কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক না থাকলে সেটা অপ্রতুল হবে। তাদের কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা গেলে কাজটা অনেক সহজ হবে।
ভূমিকম্প মোকাবেলায় ২০২৪-২৫ সালে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় ১১টি ভূমিকম্পপ্রবণ শহর নির্ণয় এবং কনটিনজেনসি পরিকল্পনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জরুরি সাড়া দান পদ্ধতিও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়াও থমকে গেছে।
ভবন তৈরিতে নিয়ম না মানা জরুরি: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ভবন ভূমিকম্প সহনশীল হলে ৯০ শতাংশ মানুষকে বাঁচানো সম্ভব যদি হয়। ঢাকা শহরে ছয় লাখ ভবন আছে। ১০ তলা বা তার বেশি আছে দুই হাজার ১০০ ভবন। ছয় লাখের তুলনায় দুই হাজার ১০০ কিছুই না। কত শতাংশ ভবন ভেঙে পড়তে পারে, সেই ধারণা দেয়ার জন্য যদি বলি, রানা প্লাজা ধসের পর আমরা প্রায় তিন হাজার ৫০০ ফ্যাক্টরি বিল্ডিং চেক করেছি। সেখানে আমরা তিনটি ভাগ করেছি, এর মধ্যে রেড ক্যাটাগরিতে ছিল যেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ইয়োলো ক্যাটাগরিতে ছিল কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং গ্রিন ক্যাটাগরিতে ছিল সেগুলো নিরাপদ। এর মধ্যে ২৫ ভাগ পেয়েছি রেড ক্যাটাগরিতে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সূত্র জানায়, ভবন নির্মাণের সময় কংক্রিটের মান তিন হাজার পিএসআই থাকা উচিত হলেও থাকে এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার পিএসআই। রডের গুণগত মান থাকা উচিত ৭০ থেকে ৮০ পিএসআই। অথচ সেটা পাওয়া যায় ৪০ পিএসআই। ফলে ভবনের দুর্বলতা বেড়ে যায়। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে কলামে ঘন ঘন রড দিতে হয়। এগুলো না মানলে ওই ভবনগুলো ভূমিকম্পে ধসে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব জরিপ ও গবেষণা সংস্থা ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে ১৭৬২ সালে ৮ পয়েন্ট ৫৯ মাত্রায় ভূমিকম্প হয়। যেটার কারণে সেন্টমার্টিনের উৎপত্তি বলেই অনেক মনে করেন। যেহেতু একবার হয়েছে আবারো এখানে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ আড়াই শ’ বছর হয়ে গেছে। বলা হয়, এই ভূমিকম্পগুলো আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ বছর পরপর হয়। দ্বিতীয় ধাপে যেটা হয়েছে, ১৮৬৯ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত পাঁচটা বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে এখানে। ১৮৮৫ সালে ৭ দশমিক ১ মাত্রায় হয়েছে। যেটা যমুনা সেতু থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। তা ছাড়া ১৮৬৯ সালে ৭ দশমিক ৫ মাত্রায়, ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭৯ মাত্রায় হয়েছে। তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৯০ হাজার। এখন প্রায় ২ কোটি। তখনই ঢাকায় প্রায় ১০০টা পাকা দালান ভেঙে ১৫ জন মারা যায়। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে এবং সর্বশেষ যেটা হয়েছে, ১৯৩০ সালে ৭ দশমিক ১৯ মাত্রায় রংপুর এলাকায়। গবেষকরা বলেন, ৭ মাত্রার নিচে ভূমিকম্প এক শ’ থেকে দেড় শ’ বছর পরপর আসতে পারে। আর যেগুলো ৮-এর অধিক সেগুলো আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ বছর পরপর আসতে পারে। সে হিসাবে ৭ মাত্রার ভূকম্পন যেকোনো সময় হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশে।
ভূমিকম্পে নিহত রাফির মৃত্যু সংবাদ জানে না আহত মা:
বগুড়া অফিস জানায়, ঢাকায় ভূমিকম্পে ধসে পড়া বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়ে নিহত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ৫২তম ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাফিউল ইসলাম (২৩) ওরফে রাফির দাদাবাড়ি গোহাইল রোড, সূত্রাপুর ও নানাবাড়ি বগুড়া সদরের চাঁদপুর। মেধাবী এই ছাত্রের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে আত্মীয়স্বজন ও সহপাঠীদের মধ্যে।
নিহত রাফির খালা ব্যাংকার সৈয়দা নাদিয়া আকতার জানান, রাফি বগুড়া আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। রাফির বাবা মো: ওসমান গণি দিনাজপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ, মাতা নুসরাত জাহান গৃহিণী ও বড় বোন আতিয়া ওয়াসিম (রাইতা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিভাগের (বোটানি) মাস্টার্সের ছাত্রী। রাফির সাথেই তার মা বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়ে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তিনি মাথায় আঘাত পাওয়ায় তার মাথায় অপারেশন করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে কিছুটা সুস্থ । তবে তাকে ছেলের মৃত্যুর খবর এখনো জানানো হয়নি।