বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫, ১২:০২ অপরাহ্ন

অন্তরার মেডিকেলে ভর্তি ও পড়া নিয়ে দুঃচিন্তায় পরিবার

বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি:: দরিদ্র পরিবারের মেয়ে মোসাঃ অন্তরা খাতুন। তাই নিজেকে আড়াল করে রাখতো সহপাঠিদের কাছ থেকে। বৃথা কাজে যাতে সময়টুকু নষ্ট না হয় সেজন্য সময়ের দাম দিতো সে। সহপাঠিরা যখন ক্লাসের ফাঁকে হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠত, অন্তরা তখন ব্যস্ত থাকতো বইয়ের পাতায়।

পিতার মৃত্যুর পর, সংগ্রাম করেই লেখা পড়া করতে হয়েছে তাকে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছে অন্তরা। মা-ভাইয়ের পরিশ্রমের টাকা আর নিজের টিউশনির পাওয়া টাকায় লেখা পড়া করা অন্তরা এখন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। মেধা আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে প্রাথমিক থেকে শুরু করে এইচএসসিতেও ফলাফল ভালো করেছে।

এদিকে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেও অনেকটাই হতাশ ও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অন্তরার পরিবার। কারণ মেডিকেলে ভর্তি হওয়া ও পড়ালেখার খরচ কিভাবে জোগাড় করবেন সেই চিন্তায় দিন কাটছে তাদের। তবে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে বিধবা মা রসুনা বেগম (৪৭) ও তার বড় ভাই সোহেল রানা চেষ্টা চালাচ্ছেন অন্তরাকে ডাক্তার বানানোর। মোসাঃ অন্তরা খাতুন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাজুবাঘা ইউনিয়নের বড়ছয়ঘটি গ্রামের দিনমজুর আলাউদ্দিন প্রামানিকের মেয়ে।

জানা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে অন্তরা যখন উচ্চ মাধ্যমিকে পা বাড়ায় তখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ। মনোবলকে শক্ত করে একবুক আশা নিয়ে এইচএসসিতে ভর্তি হয় নিজ উপজেলার শাহদৌলা সরকারি কলেজে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২০২১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। তাছাড়াও পি ই সি ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি, জে এস সি ও এএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ব্রাক স্কুলে ভর্তির আগেই অন্তরার পিতা মারা যায়।

অন্তরার মা রসুনা বেগম জানান, আঠারো বছর আগে স্বামী আলা উদ্দীন এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মারা যান। তখন ছেলে সোহেল রানার বয়স ছিল প্রায় ৭ বছর আর অন্তরার বয়স ছিল দেড় বছর। সম্বল বলতে ছিল স্বামীর পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া বাড়ি ভিটার আড়াই কাঠা আর মাঠের ৩ কাঠা জমি। তাই জীবনের সাথে সংগ্রাম করে রাইচ মিলে কাজ করা ছাড়াও অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে ছেলে-মেয়ের খাবার ও লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন। সংসারের টানপোড়ন দেখে সোহেল রানা লেখা পড়া বাদ দিয়ে আমার সাথে নেমে পড়ে জীবন সংগ্রামে। সোহেল রানা সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে।

রসুনা বেগম বলেন, আমার মেয়েটা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এতে যেমন আনন্দ লাগছে, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় রয়েছি মেয়ের ভর্তি আর পড়াশুনা নিয়ে। আমি কি পারব শেষ পর্যন্ত মেয়েকে ডাক্তারী পড়াতে।

সাক্ষাৎকারে অন্তরা খাতুন তার জীবনের সাফল্যের কথা তুলে ধরে বলেন, নিম্নবিত্ত একটি দরিদ্র পরিবার থেকে এ পর্যন্ত উঠে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এস,এস,সি পাশের পর নিজ উপজেলার শাহদৌলা সরকারি কলেজে এইচএসসি’তে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। ওখানে পড়ার সব টাকা জোগাড় করা আমার মা-ভাইয়ের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তাই অনেক কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে, কলেজ শিক্ষক হাফিজুর রহমানের সহায়তায় তারই কোচিং সেন্টারে ছেলে-মেয়েদের ক্লাশ নিতাম। সেখানের সীমিত আয় ও বাড়িতে টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ যুগিয়েছি। মেডিকেলে ভর্তির জন্য ঢাকার রেটিনা মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কোচিং-এ ভর্তি হই। মায়ের পোষা গাভীটি ষাট হাজার টাকায় বিক্রি করে সেখানকার খরচ যুগিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছি। আবেগে আল্পুত হয়ে অন্তরা বলেন, জানিনা কতদূর এগোতে পারব। তবে ইচ্ছা আছে মেডিকেলের পড়া শেষ করে একজন আদর্শ চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবো।

চন্ডিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মোঃ ফজলুল রহমান জানান, অন্তরা তার স্কুর থেকে এসএসসি পাশ করেছে। নিজের ইচ্ছা আর মা-ভাইয়ের কষ্টের উপার্জিত টাকায় লিখা পড়া করেছে।

শাহদৌলা সরকারি কলেজের প্রভাষক আব্দুল হানিফ বলেন, অন্তরা খুবই ভদ্র ও মেধাবী ছাত্রী। জানা মতে, পারিবারিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সব সময় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। দোয়া করি ও যেন তার পরিবারের স্বপ্নপূরণ এবং দেশ ও জন সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com