শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:১১ অপরাহ্ন

ইসলামে আশুরার গুরুত্ব | যুগে যুগে আশুরা | আলমগীর হোসেন শিশির

১০ই মহরম পৃথিবী ধ্বংস হবে! “যুগে যুগে আশুরা”
★ আদম (আ)কে সৃষ্টি করা হয় আশুরার দিন।
★ পৃথিবী ধ্বংস হবে আশুরার দিন
★ কারবালায় হুসাইন (রা) শহীদ হন একই দিনে।

আজ যুগে যুগে আশুরা নিয়ে কিছু গবেষণাধর্মী আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। একজন জ্ঞান পিপাসু মানুষ হিসাবে এই বিষয়ে কিছুটা হলেও জানা আমার-আপনার নৈতিক ঈমানী দায়িত্ব।

 আশুরার দিনের আরো কিছু ঘটনা :
মুহররমের ১০ তারিখে আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেক ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। অসংখ্য ঘটনা থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ১০ই মহরম পৃথিবী ধ্বংস হবে! কিন্তু কত সালে? চলুন দেখি……
 আসমান-জমিন সৃষ্টি :
মহান আল্লাহুপাক “কুন” শব্দের মাধ্যমে মেঘ সৃষ্টি করলেন। সেই মেঘ থেকে ৪০ হাজার বছর বৃষ্টি হল। চারিদিকে পানি আর পানি । অথৈই পানি। এরপরে আল্লাহুপাক “কুন” শব্দের মাধ্যমে ঝড় সৃষ্টি করে ঝড়কে হুকুম করলেন পানির উপরে আঘাত হানতে। প্রচন্ড ঝড়ে পানি বাষ্প হয়ে সাত স্তরে রুপান্তরিত হল এবং পানিতে ফেনা সৃষ্টি হয়ে সাত স্তরে পরিণত হল। এই সাত স্তর বাষ্পে তৈরি হল আকাশ আর সাত স্তর ফেনায় তৈরি হল সাত তবক জমিন। মোটকথা যেদিন আকাশ-জমিন আল্লাহুপাক সৃষ্টি করলেন সেদিন ছিল ১০ই মহররম, আশুরার দিন। এরপরে চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর বিবিধ কিছু সৃষ্টি করা হয় এই মহররম মাসেই।
 আদম ও হাওয়া (আ) :
আমরা জানি বাবা আদম (আ) আল্লাহর সৃষ্টির প্রথম মানুষ। তিনি কোন মায়ের পেটে জন্ম গ্রহণ করেননি। সরাসরি আল্লাহু তায়ালা তাকে একজন সুদর্শন যুবক হিসাবে সৃষ্টি করেন। এই ১০ই মহররম আদম (আঃ) কে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়। এরপরে গন্দম ফল ভক্ষণ করার কারণে যেদিন আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ) কে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ কর হয়, সেদিনও ছিল আশুরার দিন। দীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছর অশ্রু বিসর্জন করার পরে আদম (আ.) এর তওবা আল্লাহুপাক কবুল করেন এই আশুরাতেই। এরপরে পুণরায় মা হাওয়া (আ.) এর সাথে আদম (আ.) এর সাক্ষাত হয়েছিল এই ১০ই মুহররমে।
 জাহেলদের চোখে মহররমের গুরুত্ব :
ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে এ মাসকে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের চোখে দেখা হতো। এর পবিত্রতা ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করেই যুদ্ধপ্রিয় আরবরা এ মাসে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘মহররম’ বা ‘মর্যাদাপূর্ণ’ বলে।
আরবের জাহেলরাও মহররম মাসটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিত। অনেকেই ভাবছেন আরবে সকল ক্যালেন্ডার তৈরি হয় আরবি মাস ঘিরে। তাদের সকল ধরণের ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন হয় হিজরী সন অনুযায়ী সুতরাং সেটা নতুন কিছু নয়। আমরা যখন বাংলা নববর্ষ ইংরেজি নববর্ষ পালন করি তেমনি আরবীয়রা পালন করে হিজরী সন। সেখানে হিজরী সনের গুরুত্ব তো তাদের হবেই। বিষয়টি শুধু এখানেই সিমাবদ্ধ নয়। আরবি মাসের নানান গুরুত্বের কারণে তারা আরবি মাসকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
 মুসলীম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ):
ইব্রাহীম খলিল জন্মগ্রহণ করেন আশুরাতেই । আমরা জানি হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় অসংখ্য কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তাঁর সকল পরীক্ষার ভিতরে অন্যতম একটি পরীক্ষা ছিল নমরুদের অগ্নিকুন্ড। এই অগ্নীকুন্ডে হযরত জিব্রাঈল (আ) এসে বলেন- আপনি একবার হুকুম করুন আমি এই আগুণকে নীলনদে নিক্ষেপ করি। প্রতিউত্তরে তিনি বলেছিলেন-কেন আপনি সেটা করবেন? আমি যে আল্লাহর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত তিনি কি চোখে দেখছেন না? তিনি যদি আমাকে আগুণে পুড়িয়ে খুশি থাকেন। তবে আমার আগুণে পুড়তে কোন আপত্তি নেই। জাতীর পিতা ইব্রাহিম (আ) এর এমন কথায় আল্লাহ খুশি হয়ে যান। মহান আল্লাহ আগুণের প্রতি হুকুম করেন- হে আগুণ তুমি আমার ইব্রাহীমের জন্য আরামদায়ক হয়ে যাও। আশুরার দিন হযরত ইব্রাহিম (আ.) জালিম বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে নিরাপদে মুক্তি পেয়েছিলেন।
 হযরত মূসা (আ.) ও আল্লাহর সাক্ষাৎ:
হযরত মুসা (আ) ছিলেন সকল নবীদের ভিতরে একটু রাগী নবী। তিনি তুতলাও ছিলেন। এই দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের জেলখানা থেকে মুক্তি লাভ করেন । আমরা অনেকেই জানি হযরত মুসা (আ) এর সাথে একবার আল্লাহ তায়ালার দীদার হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা সেই দিন কবে ছিল । ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। সেদিনটি ছিল মুহররম মাসের আশুরার দিন অর্থ্যাৎ ১০ই মহররম। তওরাত কিতাব ছিল ৫০ খন্ড। যা শ্বেত পাথরে খোদায় করে লেখা ছিল। প্রতিটি খন্ড বহন করতে প্রয়োজন হত বোজা বহনকারী যুবকের। সেই তওরাত কিতাব যেদিন হযরত মূসা (আ.) এর উপর নাজিল হয়েছিল, সেদিন ছিল আশুরার দিন। এই আশুরাতেই মূসা (আ.) তার সাথীদের নিয়ে নীল মনদ পার হন এবং ফেরাউন বাহিনী পানিতে ডুবে মৃত্যু বরণ করে। তখনই কেবল নীলনদের তলদেশে সূর্যের আলো স্পর্শ করে। এছাড়া আর কোনদিন সূ্র্য়ের আলো নীল নদের তলদেশে পৌঁছাতে পারেনি। ফেরাউনের লাশ আজও মিশরের যাদু ঘরে সংরক্ষিত আছে। পৃথিবীর সকল অত্যাচারি শাসকদের জন্য এটি একটি শিক্ষা। পৃথিবী কারো আসল ঠিকানা নয়।
 হযরত আইয়ুব (আ.)
নবী আয়ূব (আ) এর পবিত্র স্ত্রী বিবি রহিমা ছাড়া সবাই রোগ সংক্রমণের ভয়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এটাও স্পষ্ট যে রোগের কারণে তাঁকে নির্জন ও নিঃসঙ্গ থাকতে হত। বন বাদাড়ে খেয়ে না খেয়ে কাটে তার জীবন। শরীরের প্রতিটা অংশে জীবন্ত পোকা কুট-কুট করে কামড়াতে থাকে। সে এক ভয়ংকর যন্ত্রণা। ভাবতেই গা শিহরে ওঠে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষাতে বনের ভিতরে একটি ঝুঁপরি কুঁড়ে ঘরে থাকতেন তিনি। দীর্ঘ আঠারো বছর পরে কঠিন ঈমানী পরীক্ষায় বিজয় লাভ করে, ১০ই মহররম রোগমুক্ত হন তিনি। এরপরে তিনি আবারও তাঁর হারানো বাদশাহী ও শান-শওকত ফিরে পান।
 হযরত সোলায়মান (আ.)
নবীর সন্তান নবী এবং বাদশার সন্তান বাদশা ছিলেন তিনি। সোলায়মান নবী খুবই ঈমানদার, জ্ঞানী এবং চৌকষ ছিলেন। জীব জন্তু কীট পতঙ্গের ভাষা বুঝতে পারতেন তিনি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পাওয়ারফুল একজন নবী। কিন্তু কোন এক ঘটনাচক্রে তাঁর হাতের আংটিটি হারিয়ে যায়। সে এক লম্বা কাহিনী। পরবর্তিতে এক জেলে কন্যাকে বিবাহ করেনন তিনি। কিন্তু কেউ জানতোনা তিনি নবী সুলাইমান (আ)। সেই জেলে কন্যা বাশর রাতে তাঁর হাতে সেই সোলায়মানী আংটি পরিয়ে দেন। সুলাইমান নবী আবার ফিরে পান তাঁর বাদশাহী। তিনি নতজানু মস্তকে আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। তিনি যেদিন পূণরায় বাদশাহী ফিরে পান সেদিন ছিল আশুরার দিন। আশুরাতেই তাঁর বাবা দাউদ (আ.) এর একটি বিশেষ তওবা কবুল হয়।
হযরত ইউছুফ (আ.)
হযরত ইউসুফ (আ) ছিলেন খুব সুন্দর রুপের অধিকারী। তাঁর চেহারা ছিল চাঁদের থেকেও সুন্দর। তাঁর দিকে দৃষ্টি গেলে সেই দৃষ্টি ফেরানো কঠিন ছিল। তিনি এত সুন্দর ছিলেন। তার রুপে গোটা পৃথিবী পাগল ছিল। তাঁর বাবা ইয়াকুব (আ)ও একজন নবী ছিলেন। ইউসুফ (আ)কে খুব ভালোবাসতেন তিনি । এই ভালোবাসায় কাল হয়। তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরা তাকে বনের ভিতরে একটি কুয়ার ভিতরে ফেলে আসে। ঘটনাচক্রে এক সময় মিশরের প্রেসিডেন্ট হয়ে যান তিনি। এরপর্তিতে যেদিন তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) এর সাথে মিলিত হন সেদিন ছিল আশুরার দিন।
 হযরত ইসা (আ.)
বিনা পিতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এই কারণে খ্রিষ্টানরা তাকে আল্লাহর পুত্র বলেন। যা সম্পূর্ণ শিরক। হযরত ইসা (আ.) মা মরিয়মের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন আশুরাতেই। এই আশুরাতেই আল্লাহপাক সশরীরে তাকে আসমানে তুলে নেন । শেষ জমানায় তিনি আবারো পৃথিবীতে আসবেন। কাফেরদের হত্যা করে পৃথিবী পাপ মুক্ত করবেন। বিবাহ করে সংসার করবেন এবং ৪০ বছর পরে চূড়ান্ত ভাবে তিনি মৃত্যু বরণ করবেন।
* আশুরাতেই আল্লাহপাক হযরত ইদ্রিস (আ.) কে জীবিত করেন এবং তাকে জান্নাতে উঠিয়ে নেন।
* হযরত নূহ (আ.) এর জাহাজ চল্লিশ দিন পর পাহাড়ের কিনারে ভিড়ে আশুরাতেই। আশুরাতেই হযরত নূহ (আ.) জমিনে অবতরণ করেন।
* আশুরাতেই উম্মতে মুহাম্মদীর গুনাহ মাফ করা হয়।
* জিব্রাইল (আ.) আশুরাতেই দুনিয়াতে আগমন করেন।
* আল্লাহপাক দুনিয়াতে প্রথমবার রহমত নাজিল করেন ও রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন আশুরাতেই।
 ইউনুস (আ)
কোন এক বিশেষ কারণে নদীর পার হবার সময় প্রচন্ড ঝড় ওঠে। পানিতে পড়ে যান ইউনুস (আ)। এক ক্ষুধার্ত মাছ নবী ইউনুস (আ) গিলে খেয়ে ফেলেন। মাছটি তখন গভীর সমুদ্রের তলদেশে চলে যায় এবং কাঁদার উপরে শুয়ে থাকে। কিন্তু মাছটি কোন ভাবেই নবী ইউনুস (আ)কে হজম করতে পারেনা। ছটফট করতে থাকে মাছটি। একটি জীবন্ত প্রাণীর পেটের ভিতরে আর একটি জীবন্ত প্রাণী। দুনিয়ার জানেনা সে খবর। কিন্তু আমার আল্লাহ ঠিকই জানেন। দীর্ঘ ৪০ দিন পরে মাছ পেট থেকে আবারও পৃথিবীতে আগমন করেন হযরত ইউনুস (আ)। আপনারা বুঝতেই পারছেন সেদিনও ছিল আশুরার দিন।
লাউ তরকারী:
এখানে আর একটি কথা বলে রাখি। লাউ তরকারী
আমাদের অনেকেরই পছন্দের কিন্তু আমরা কেউ জানিনা লাউ তরকারী কিভাবে পৃথিবীতে এলো। ইউনুস (আ)এর জীবনী পাঠের মাধ্যমে জানা যায়, হযরত ইউনুস (আ) যখন ৪০ দিন পরে মাছের পেট থেকে মুক্ত হয়ে সমুদ্রের কূলে এলেন তখন সূর্যের তাপে তাঁর শরীরে জ্বালা পোড়া করতে লাগলো এবং শরীর জুড়ে ঘা তৈরি হতে লাগলো। তখন তিনি আল্লাহর দরবারে এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে দোয়া করলেন। তাঁর দোয়া আল্লাহ কবুল করে বললেন- তুমি সমুদ্রের কূলে দেখো একটি লাউ গাছ আছে। তুমি লাউ খাও, আর এর পাতা শরীরের ক্ষত স্থানে লাগাও, ঠিক হয়ে যাবে। এভাবেই লাউ তরকারী পৃথিবীতে এলো। বেশি বেশি লাউ খাও আর দেহের পুষ্টিগুণ বাড়াও।
রক্তাক্ত কারবালা:
 হোসাইন (রা.)-এর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল খিলাফত ব্যবস্থার পুণর্জীবন। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে হোসাইনের (রা.) স্ত্রী, ছেলে, বোন ও ঘনিষ্ঠ ২০০ অনুচর নিয়ে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে পৌঁছালে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাকে বাধা দেন। রক্তপাত ও খুনাখুনি বন্ধের উদ্দেশে হজরত হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব দেন। এক. তাকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক। দুই. তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেওয়া হোক। তিন. ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দামেস্কে পাঠানো হোক। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন। হজরত হোসাইন (রা.) ঘৃণা ভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন।
শিশু সন্তান আলী আজগর পানির জন্য ছটফট করতে থাকে। হযরত হোসাইন (আ) আলী আজগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর কুলে আসেন। তিনি এজিদের সৈন্য বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন- আপনারা অনেকেই আমার নানাজী দেখেছেন। অনেকেই আমার দেখেছেন। নবী বংশের এই শিশুটি পানির জন্য ছটফট করছে। তাকে একটু পানি খেতে দিন। এই ফোরাতের পানি কত পশু পাখি খাই। কত পানি নষ্ট হয়। কিন্তু পাপিষ্ঠ পাষান্ড এজিদ বাহিনী ক্ষমতার অহংকারে অন্ধ হয়ে যায়। আলী আজগরের দিকে তীর নিক্ষেপ করে। তীরটি আলী আজগরের বুক ভেদ করে বের হয়ে যায়। আলী আজগর হোসাইন (রা) কোলে ছটফট করতে করতে মারা যায়।
অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী হজরত হোসাইনকে (রা.) অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে পানির হাহাকার শুরু হয়। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করতে আসিনি, এমনকি ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়। খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার আমার কাম্য।
ইয়াজিদ বাহিনী ১০ মুহাররম তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ অসম যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া ৭০ থেকে ৭২ জন শহীদ হন। হজরত হোসাইন (রা.) মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যান। অবশেষে তিনি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। হজরত হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে পাঠানো হয়। এজিদের সামনে হোসাইন (রা) ছিন্ন মস্তক আনা হলে এজিদ হাতের লাঠি দিয়ে মুখে ঢুকিয়ে খোঁচাতে থাকে এবং অট্টহাসি দিতে থাকে।
ওই সময় ওই রাজ সভায় ছিলেন এক নারী। তিনি হুসাইনের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ দেখে সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে বলেন- তোমাদের কলিজায় কি মরণের ভয় নেই? তোমরা কত ভাবে নবী বংশের সন্তানকে অপমান করবে? তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর সাথে তামাসা করছো? কোন মুখে তুমি লাঠি ঢুকাচ্ছো? যে মুখে বিশ্বনবী শত শত বার চুমু খেয়েছেন! তোমরা কি ভুলে গেছো হযরত হোসাইন (রা)কে আল্লাহর রাসুল (সা) কত বেশি ভালোবাসতেন। এখনই ক্ষ্যান্ত হও। তানা হলে আল্লাহর গজব নামবে। এজিদ ওই নারীরও শীরচ্ছেদ করে।
 একসময় এজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যর্পণ করলে কারবালা প্রান্তরে তাকে কবরস্থ করা হয়। ইতিহাস সাক্ষী, হজরত হোসাইন (রা.)-কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে করুণ পন্থায় তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। (সূত্র: কারবালার ইতিহাস, আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)।
 আশুরা নামের উৎপত্তি:
আশুরা হলো ইসলামের একটি ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস। এটি প্রতি হিজরী চন্দ্র বর্ষের মহররম মাসের দশম দিবসে পালিত হয়। ‘আশুরা’ শব্দটি আরবি। ‘আশারা’ শব্দমূল থেকে এসেছে । আশুরা অর্থ দশ। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহররমের দশম দিবসকে ‘আশুরা’ দিবস বলে অভিহিত করা হয়। হিজরি বর্ষের সূচনা হয় এ মহররম মাসের মাধ্যমেই। ‘মহররম’ শব্দের অর্থ পবিত্রতম ও মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, হাদিস শরিফে এ মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ মাস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ ও সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এসব মাসে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করো না’ (সুরা : তাওবা-৩৬)।
আশুরার ইবাদৎ
হজরত কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অছিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমাদ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ; যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদা সম্পন্ন।’ আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে নবীজি (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবী (সা.) তাদের এই দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলেন। জানতে পারলেন এদিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এই দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের জেলখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং তাদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যান। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।
মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য। এরপর তিনি ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ মহররম অথবা ১১ মহররম মিলিয়ে ২টি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজা রাখার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ব্যতীত অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। (মুসলিম ও আবু দাউদ)।
আশুরায় পাপ কর্ম:
আশুরাকে কেন্দ্র করে জাজিরা মিছিল বের করা সম্পূর্ণ মুর্খের কাজ। “হায় হোসেন হায় হোসেন” বলে নিজ শরীরে আঘাত করে রক্তাক্ত করা অনেক বড় পাপের কাজ। শিয়া সস্প্রদায় এটি করে থাকে। ইদানিং মুসলীমদের ভিতরেও এটি লক্ষণীয় । শিয়াদের বড় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিও জাজিরা মিছিল করতে নিষেধ করেছেন। ইসলামে এর কোন ভিত্তি নেই। এটি ঈমানহারা জঘন্য কাজ।
পৃথিবী ধ্বংস
আল্লাহর হুকুমে মুহররম মাসের কোন এক আশুরার দিন হযরত ইস্রাফিল (আ) তাঁর হাতে রাখা সিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন। মূহুর্ত্বের ভিতরে পৃথিবী ধ্বংস হতে থাকবে। পাহাড়, পর্বত ধুলি কণার মত উড়তে থাকবে। গ্রহ নক্ষত্র ছিঁটকে পড়তে থাকবে। পৃথিবীর মানুষ সেদিন দিক-বেদিক ছুটতে থাকবে। পালাতে থাকবে কিন্তু তারা পালাতে পারবেনা। তারা বলবে পৃথিবীর আজ একি কি হাল। বিজ্ঞানের বড় বড় চোখ ধাঁধানো আবিষ্কার সেদিন কোন কাজে আসবেনা। যেদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে সেদিন হবে আশুরার দিন, শুক্রবার।
শেষাংশ
আশুরা মানেই রক্তাক্ত কারবালা নয়। আমরা এই বিষয়ে বিতর্ক পরিহার করি। হাতের পাঁচটি আঙুলই হাতকে সৌন্দর্যময় করতে প্রয়োজন। ডিম আগে নাকি মুরগী আগে, এই হিসাব চলতেই থাকবে। যুগে যুগে আশুরা চলতেই থাকবে। আমরা আশুরার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি এবং আল্লাহর দেখানো পথে চলি। তবেই আমরা সফল হতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
আলমগীর হোসেন শিশির

আলমগীর হোসেন শিশির

রচনা ও সম্পাদনা:

-আলমগীর হোসেন শিশির
গীতিকার: বাংলাদেশ টেলিভিশন
প্রযোজক: আনন্দ টিভি (অনুষ্ঠান বিভাগ)
তারিখ: ৯ মুহররম
২৯ শে আগষ্ট
স্থানঃ আনন্দ টিভি

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com