বুধবার, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:০২ পূর্বাহ্ন

সাব-রেজিস্টারের কার্যালয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অনিয়মের অভিযোগ!

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি॥ সাতক্ষীরা রেজিস্ট্রী অফিসে পৌরসভার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার জেলা রেজিস্টারের নির্দেশে কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।

শনিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) স্থানীয়রা সাংবাদিকদের জানান, রেজিস্ট্রী অফিস চত্বরে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করতে অফিসে আর্থিক সুবিধা নেয়। আর স্থানীয় কিছু দরিদ্র পরিবার রেজিস্ট্রী অফিসের সামনে রাস্তার ধারে চা, পান, বিস্কুট, শরবত ও কিছু খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করতো। কিছু দলিল লেখক এসব দোকানদের সাথে খারাপ আচারণ ও বকেয়া টাকা পরিশোধ না করতে পারায় কৌশলে অবৈধ স্থাপনা হিসেবে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। নিরুপায় হয়ে তারা এখন ঘুরছে পথে পথে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নকল নবিশ বলেন, ‘দলিল লেখক খান সুমনের ভ্রাতা লাল্টু রেজিস্ট্রী অফিসকে নিজ সম্পত্তি মনে করেন। জেলা রেজিস্টার, সাব রেজিস্টারসহ নিবন্ধন অধিদপ্তরের নাম ভাঙিয়ে সে দলিল লেখার সনদপত্র দেওয়ার নামে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া অভিঙ্গতার সনদ, এমপিদের সুপারিশ, নকল দলিল তৈরিসহ নানা অপকর্মে জড়িত লাল্টুর আতংকে স্থানীয় দলিল লেখকরা।

দলিল লেখক সাজেদুর খান সুমন বলেন, ‘আগে জেলা রেজিস্ট্রার ঘুষ নিলেও আমরা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেতাম। আর এখন স্লিপের মাধ্যমে জেলা রেজিস্টারের নামে টাকা উত্তোলন হলেও আমরা কোন সুযোগ সুবিধা পাইনা। অথচ, জেলা রেজিস্টার ও সাব রেজিস্টার যৌথভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে রেজিস্ট্রী অফিসকে জিম্মি করে রেখেছেন। অফিস চত্বরের বাইরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও অফিস চত্বরে অবৈধ স্থাপনা করার সুযোগ দেন তিনি।

উল্লেখ্য, সাতক্ষীরা সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচজন দলিল লেখককে দুদকের নির্দেশে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে অফিসের ৩ জায়গায় ছবিসহ তালিকা টানানো হয়েছিল। তারা হলেন, একেএম মুনসুর রহমান, সদরের খানপুর গ্রামের শাহিদুজ্জামান শাহিন, সদরের চেলারডাঙ্গীর হারুনার রশিদ, শহরের কাটিয়ার খায়রুল ইসলাম খান, শহরের কাটিয়ার মনিরুজ্জামান মনি। বর্তমানে আবার তা বিলুপ্তের পথে। ইতিমধ্যে একজন দলিল লেখকের ছবির উপরে সাদা কাগজ মেরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। উক্ত দলিল লেখকগণ সমিতির নাম ব্যবহার করে অল্পদিনে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধের একাধিকবার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ, দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলমান রয়েছে। জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ ভূয়া দলিল করার অপরাধে তাদের বহিস্কার করা হলে নিয়মিতভাবে অফিস চত্বরে দালালি করছেন তারা। জেলা রেজিস্টারের ছত্রছায়ায় এসব দলিল লেখকরা অন্য দলিল লেখকদের নাম ব্যবহার করে জমি রেজিস্ট্রী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৮, স্থানীয় ও জাতীয় কয়েকটি পত্রিকায় জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সত্যতা পাওয়ায় দলিল লেখক সমিতির মনিরুজ্জামান মনিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জেলা রেজিস্ট্রার মুন্সি রুহুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।

অফিস সূত্র জানায়, দলিল লেখক মো. মনিরুজ্জামান মনির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ৯/২০০৬) ১২৯/১৫, ৯১৩৩/১৫, ৯৪০৬/১৫ এবং ৮৬৪২/১৫ নম্বর দলিলের জমির শ্রেণি পরিবর্তন (ডাঙা শ্রেণির বদলে বিলান, বাস্ত’র বদলে ডাঙা লিখে) চার লাখ ২৯ হাজার ৯১৬ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজে পকেটস্থ করেছেন। যা চরম অপরাধ ও রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ ধারা ৮০ জির অধীন প্রণীত দলিল লেখক (সনদ) বিধিমালার বিধি ১২-এর পরিপন্থী। এছাড়া স্থানীয় কিছু দলিল লেখক ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে জেলা ও সাব রেজিস্টারকে ম্যানেজ করে জমি রেজিস্ট্রীতে জাল-জালিয়াতি অব্যাহত রেখেছেন। জেলা রেজিস্ট্রার মুন্সি রুহুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক তদন্তে মনিরুজ্জামান মনির বিরুদ্ধে রাজন্ব ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রী করেন সাব রেজিস্টার। কোন দলিল লেখকের সঙ্গে আমার সরাসরি কাজের সুযোগ নেই।

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ১লা ফেব্রুয়ারিতে ছাপা হয়েছে সাতক্ষীরায় দলিল লেখকের বাক্সে ৯টি জাল সিল! শিরোনামে একটি সংবাদ। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে হারুনার রশিদ নামের এক দলিল লেখকের বাক্স থেকে রেজিস্ট্রার ও বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রারদের নামের ৯টি জাল সিল উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন দলিল লেখক সমিতির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস, সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি। একই সাথে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে দলিল লেখক হারুনার রশিদকে।

গত মাসের ১৪ আগস্ট (মঙ্গলবার) বিকালে সাতক্ষীরা সদর সাব-রেজিস্ট্রী অফিসে জমি রেজিস্ট্রী করতে নকল সিল, স্বাক্ষর ব্যবহার করে নামপত্তন, খাজনার চেক, হাল রেকর্ডসহ সকল প্রকার কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি ও অবৈধভাবে দলিল রেজিস্ট্রী করার অভিযোগে ২জনকে জেল ও ১ জনকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাম্মী আকতার।

দলিল লেখক সুমন খান সাংবাদিকদের জানান, ‘মুস্টিমেও কয়েকজন দলিল লেখকের জন্য আমাদের সুনাম নস্ট হচ্ছে। দলিল লেখার লাইসেন্স প্রদানের নামে লাল্টু কয়েকজনের কাছ থেকে ১লক্ষ ২০ হাজার টাকা করে নিয়েছে। সকল কাগজপত্র, এমপিদের সুপারিশসহ সব কাজ সে করে নিবন্ধন অধিদপ্তরে পাঠায়। ২/৩বছর পর যথানিয়মে কাজটি সম্পন্ন হয়। এতে হয়রাণী ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে সাধারণ মুহুরিরা। সদর সাব রেজিস্ট্রী অফিসের চলমান নানান সমস্যা সমাধানের লক্ষে হাইকোর্ট জারিকৃত একটি পত্র ইতিমধ্যে পেয়েছেন জেলা রেজিস্টার মো. রুহুল ইসলাম ও সাব রেজিস্টার মো. রফিকুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাম্মী আকতার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সদর সাব রেজিস্ট্রী অফিসে জাল-জালিয়াতি ও নকল সিল ব্যহারের অভিযোগে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। দালাল ও দলিল লেখকদের মধ্যে যারা এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যে কোন সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।’
অনিয়মই যে অফিসের নিয়ম তার নাম সাতক্ষীরা সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। হয়রানি এ অফিসের পুরস্কার। দুর্নীতি এ অফিসের নীতিতে পরিণত হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গেলে বিড়ম্বনার শেষ নেই। প্রতি পদে পদে ঘুষ দিতে হয়। চাহিদা মতো ঘুষ না দিলে, হয় না দলিল রেজিস্ট্রি। শিকার হতে হয় হয়রানির। সাব-রেজিষ্ট্রী অফিসে নকল নবিশ লাল্টু এসব অনিয়ম এখন নিয়মে পরিণত করেছে। দুর্নীতিবাজ এ ব্যক্তির হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে ভূক্তভোগীরা প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, দুদকের পাশাপাশি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সাতক্ষীরা শহরে বিলাসবহুল বাড়ি, কোটিপতি হওয়া ও দীর্ঘ্যদিন একই অফিসে চাকুরী করার কারনে লাল্টু ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। কাউকে পরোয়া করেন না। সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতিকে নিয়মে পরিণত করেছেন। এছাড়াও অফিসের বাইরেও তার একটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে বসেই মাদক ব্যবসাসহ অফিসের বড় কর্মকর্তা পরিচয়ে চাঁদাবাজি ও প্রচারণা কার্যক্রম করেন ওই লাল্টু। লাল্টুর বিরুদ্ধের অভিযোগের তদন্ত চলছে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় তথ্যসহ প্রকাশ করা হবে।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, বাইরে থেকে সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে দরজা বন্ধ। কয়েকজন দালাল লাল্টুর সঙ্গে বসে খোষ গল্পে মত্ত।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com