বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৮:০২ পূর্বাহ্ন

ভয় যখন সম্মানের বিকল্প, সম্পদ তখন শিক্ষার বিকল্প!

রাজু আহমেদ।।
অপরের সাথে তুলনা করেই খারাপ আছি! আমার এটা নাই, ওটা পাইনি-এই আফসোসেই জীবনটা কেটে যাচ্ছে। ওর এটা আছে, সেটা পাচ্ছে-এই ঈর্ষায় নিজেকে বিষিয়ে তুলছি। যার আছে সে কেমনে পাচ্ছে আর আমার নাই, কেন পাচ্ছি না-সে বিবেচনা আমাদের খুব কম মানুষের আছে। পরেরটা দেখে নিজেকে হীন ভাবতে ভাবতে একসময় বিক্ষিপ্ত মন ছাড়া আমাদের আর কিছুই রইবে না। অথচ আমার যা আছে, যা পেয়েছি তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতাম। যেভাবে দিন কেটে যাচ্ছে তা মোটেই মন্দ নয় অথচ অন্ধ হয়ে আছি! কৃতজ্ঞতাবোধ তুলে রেখেছি। পরের চাকচিক্য দেখে লোভ হয়! ক্ষোভে একা একা পুড়ে মরি!

অপরের ভালো কোন গুণ নিজের মধ্যে আসুক সে চেষ্টা আমাদের মধ্যে অনেকটাই অনুপস্থিত। খেয়াল করে খুঁজে দেখুন, নাই। একজন সৎ মানুষ, তাকে দেখে সৎ হতে চাই না। একজন সহজ সরল ভালো মানুষ, তাকে দেখে ভালো হতে চাই না। বরং নীতিবান মানুষকে বোকা বলি! সৎ মানুষকে সিধা বলি! আদর্শিক মানুষকে সেকেলে বলি! সত্যবাদীকে জীবনের গন্ডি থেকে দূরে রাখি। অথচ আমাদের ঈর্ষায় একজন ঘুষখোর-অসৎ! তার মত আমি পাই না কেন! আমরা বিনীত হই একজন ক্ষমতার অপব্যবহাকারীর কাছে! আমরা আদর্শ মানি রসালো মিথ্যাবাদীকে। অনুসরণীয় করি নীতিহীন পাপীকে! এদের সাথে নিজেদের তুলনা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলি! অথচ এদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে শুকরিয়া আদায় করা উচিত ছিল!

আমরা আজকাল সঠিক মানুষকে ঘৃণা করি এবং ভুল মানুষকে মনের সিংহাসনে বসাই। আমাদের বিভিন্ন শ্রেণির অভিভাবকদের খোঁজখবর নিলেই সামাজিক চরিত্র স্পষ্ট হয়। অর্থ এবং ক্ষমতাকে সবকিছুর মানদন্ড করা হয়েছে। জ্ঞান এবং সম্মানকে একপেশে করে রাখার প্রবণতা প্রবলভাবে স্পষ্ট। ভালোর পক্ষে এবং বিপক্ষের শক্তি দেখেই আপনি সমাজ মাপতে পারবেন। টাকাই যেখানে মর্যাদা মাপার মানদন্ড, পরের সাথে তুলনা করেই যদি বুঝতে হয় আমি সুখী কি-না তবে একটা জীবনে আফসোসে গেলে সেটা নিয়ে আর আফসোস না করলেই ভালো! ভয় যেখানে সম্মানের বিকল্প, সম্পদ যেখানে শিক্ষার বিকল্প সেখানে ভালোরা আর আলো ছড়াবে না- সেটাই তো স্বাভাবিক! যে সমাজে লাঠিয়াল নেতৃত্ব দেয় সেখানে নীতির নেতৃত্ব প্রায় হারাম ঘোষিত হয়! বেতনের চেয়ে ঘুষের কদর যে সমাজে বেশি সেখানে কলমের কালির শুদ্ধতা থাকবে না-সেটাই তো ঘটছে।

দিনে দিনে বুদ্ধি-বিবেক ক্ষোভের ক্ষতে চাপা পড়েছে! আমরা সমাজের নিচুস্তরের মানুষদের মূল্যায়ণ করতে ভুলে গেছি। যারা বিত্তশালী, যাদের হাতে ক্ষমতার ছড়ি তাদের লেজে লেজে নমঃ নমঃ করে ঘুরছি! তাদের নিক্ষিপ্ত উচ্ছিষ্ট জীবনের পরম পাওয়া ভেবে বুকে আগলে রাখছি। সমাজের যে যতবেশি ভ্রষ্ট, যার ভেতরের চেপে থাকে নষ্টামীর কুচিন্তা তাকে তত উঁচুতে তুলে রেখেছি! তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে আফসোস করি! হায়, আমি সেখানে কেন নই! যে বৈধভাবে পেয়েছে এবং যে পায়নি তাদের দু’জনের চেষ্টা ও পদ্ধতিতে পার্থক্য ছিল না? ভাগ্যকে কি অস্বীকার করতে পারবেন? সবকিছুর পরেও, আমার যা কিছু আছে তা নিয়েও তুষ্ট থাকে পারি! কিন্তু ক্ষুধা এবং লোভ কিছুতেই মিটছে না বলে অসুখীর তালিকা হলে সেখানে প্রখম দিকেই থাকতাম! জীবনকে বড় বেশি তুলনার নিক্তি নির্ভর বানিয়ে ফেলেছি।

জীবনটাকে উপভোগ্য করা নিয়ে আমাদের উদ্যোগ নাই। ভোগের বিস্তৃতি বাড়িয়ে চলেছি। চিন্তাভাবনায় ধার্মিক অথচ কার্যক্রমে চার্বাক-এ নীতিই জীবনের আরাধ্য হয়ে উঠেছে! ভালো যা কিছু তা হারিয়ে ফেলেছি এবং যা কিছু আবর্জনা তাই কেবল সঞ্চয় করে চলেছি। প্রয়োজনীয় নয় অথচ এমন জামাকাপড়, বাসনকোসনের কোন অভাব নাই কিন্তু রুমের মধ্যে দু’খানা ভালো বই নাই। পাঠাভ্যাস তো জন্ম থেকেই অনুপস্থিত! কার কী মন্দ আছে, কোথায় কোথায় দ্বন্দ্ব আছে, কার আড়ালে কত নিন্দা আছে তা নিয়েই পড়ে আছি! প্রিয়জনের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে আমাদের প্রতিযোগিতা নাই অথচ পরকীয়া নিয়ে উৎসব! পরকাল আমাদের মুখে কিন্তু বুকে হইকালের ছাপ! আমরা খারাপ থাকবো না-তো কি শয়তান মন্দ থাকবে! আমরা দিনে দিনে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি!

অপরের সাথে তুলনাবিহীন একটা জীবন দাঁড় করাতে হবে! আদর্শ হবে বিবেক।নিজেকে নিজের মধ্যে ভালো রাখতে হবে। অল্প তুষ্টে হতে পারে সেটার চেয়ে মহোত্তম আর কিছুতেই নাই। সততার আলুভর্তায় তৃপ্তি খুঁজতে হবে। কাউকে অধিকার বঞ্চিত করে, কারো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কিংবা কারো অভিশাপ মেখে ঘি-পোলাও অবজ্ঞা ভরে উপেক্ষা করতে হবে। অল্পক্ষণের জীবনটাকে নীতির রঙে রাঙাতে পারলে সম্মান কমবে না, শান্তির বার্তা থামবে না। অনেক কিছু চেয়ে, হরেক কিছু পেয়ে যদি সুখী না হওয়া যায় তবে জীবন অর্থহীন। কতিপয় সুন্দর মনের মানুষের সাথে একটা জীবন অনায়াসে আনন্দ প্রয়াসে কেটে যাক-সে জন্য নিজে সাজি এবং অপরকে সাজাই। জীবনটা যেন সুখ ও দুঃখে নিজে নিজে ভেজাই!

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Titans It Solution