সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ১২:২৬ পূর্বাহ্ন
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক, একুশের কন্ঠ : বইমেলা শেষ! ভাষার মাসে মাসব্যাপী বইমেলা-বইপ্রেমী ও বাংলাভাষীদের এক পরম পাওয়া আর মহান তৃপ্তি! ঝাল-টক কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু সুখ কিছু ব্যথা-এসব ঘিরেই বইমেলা। বইমেলাতে আমি যা দেখি আপনারাও কি তার কিছু কিছু দেখেন? আসুন, দিখি-
এক।
শিরোনামের জন্য দুঃখিত। তবে ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে কেন্দ্র করে কত টাকার ফুচকা-চা-চুরুট বিক্রি হচ্ছে/হয়েছে তার সঠিক হিসাব প্রকাশ হলে প্রকাশক-লেখকগণ আগামী বছরের বইমেলাতে তাদের পরিকল্পনা ভিন্নভাবে সাজাত! একদিকে বইয়ের উর্ধ্বদাম, অন্যদিকে মানহীনতার প্রতিযোগিতায় কোনটা যে কেনা উচিত আর কোনটা নয়, ভিন্নদিকে লেখকদের বহুলাংশ ফেসবুকে/বিজ্ঞাপনে আমারটি নিন, আমারটি নিন বলে বলে পাঠককে বিরক্ত করা-তাইতো শীত শেষ হওয়ার আগেই রাজ্যের গরম নেমেছে! যারা সত্যিকারের পাঠক তারা বইয়ের খোঁজ খবর নিয়ে তবেই মেলায় যায়! মেলা শেষ হতেই ঠোঙ্গা কারবারীদের উপকরণ জোগাড় হবে এবং ব্যবসা জমজমাট হবে বলে তারা দিনরাত প্রার্থণা করছে এই আশায় যে, এতোদিনে ফেব্রুয়ারি ফুরালো! এখন লাভ-ক্ষতির হিসাব হবে! আর একদল যে কোন উদ্দেশ্যে মেলায় প্রবেশ করে সেকথা সভ্য সমাজে ভাষার মাসে বাংলা ভাষায় কী করে ব্যক্ত করি!
দুই।
এবারের বইমেলা ছবি তোলার মেলায় পরিণত হয়েছে। পাঠক-পাঠিকার বৃহদাংশ হাতে বই তোলে, বুকের সাথে জাপটে ধরে কিংবা সামনে মেলে ধরে চোখ ডুবিয়ে রাখে, কয়েকভাবে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলে, যেখানের বই সেখানে রাখে অতঃপর নিরুদ্দেশ হয়! দামটাও জিজ্ঞেস করে না পর্যন্ত! বই কেনার প্রশ্ন উঠলে হয়তো স্বহাস্যে বলতো, ওহ বই! সে তো আমার একখানা আছে! আবার কিনতে হবে কেন! কেউ কেউ সেজেগুজে বাংলা বর্ণমালা কয়টি সেটা না পারার জন্য, এখন বাংলা কোন সনের কত তারিখ সেটা ভুল বলার জন্য, ফেব্রুয়ারিতে কোন কোন দিবস আছে সেটা না জানার জন্য মেলায় আসে! কত কত ঢঙ করে সঙ করে! মেলায় নতুন এসেছে এসন একটি দুটি বইয়ের নাম জানতে চাইলে গলদঘর্ম হয়ে যায়। প্রেমিক-জনের সময় কাটানোর ভালো ক্ষেত্র হয়েছে বইমেলা। ছবি তুলবে, ছবি তুলবে অতঃপরও ছবি তুলবে! তারপর চলে আসবে! বইমেলা থেকে যে দু-একখানা বই কিনতে হয় সেটা ছবি তোলার ম্যানিয়ায় আগতদের বৃহদাংশ হয়তো ভুলেই বসে আছে! এটা বইমেলা না ছবি মেলা-বোঝাই বড় দায়!
তিন।
ভৌগোলিক দূরত্ব এবং আর্থিক দীনতায় প্রতি বইমেলায় একবার প্রবেশের সৌভাগ্য ঘট। যে বছর জাতির জনকের আমার দেখা নয়াচীন” প্রকাশ পেয়েছিল সেই বছর থেকে এই যাত্রা শুরু হয়েছে। বেকার জীবনের সেই তপ্ত দিনের কোন এক শুক্রবার দুপুরে, সূর্য যখন মধ্যগগণে তখন প্রবেশ করেছিলাম। খান কয়েক বইও খরিদ করেছিলাম তবে ধূলায় ধূসরিত হয়েছিলাম আরও অধিক। সে সময়ে পাঠক বলতে বোধহয় গোয়েন্দা সংস্থার গুটিকয়েক নিরীহ দর্শক আর আমরা ক’জন বেকার ছিলাম! তবে যারা নিয়মিত বই মেলায় সশরীরে যায় তাদের চেয়ে কম সংখ্যক বই সংগ্রহে আসে না! পছন্দ এবং সামর্থ্যের সমন্বয় করে যা কিনি এবং কিনতে উৎসাহ দেই তাতে স্বনামধন্য লেখক এবং মানসম্মত লেখার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করি! এ বছরের ঘটনা আরও দুঃখজনক! লোক আর লোক! খুব কম লোকের হাতেই বই! তাও ভালো! তবে ভূয়া লোক এবং ভূয়া ভূয়া বলা লোকের ভেড়া-ভিড়িতে সে এক তালমাটাল অবস্থা! তবে সিলেক্টেড বইগুলো পেয়োছিলাম বলে সফর মন্দ কাটেনি! ধুলোবালি যা খাই খেলাম!
চার।
প্রকৃত লেখকদের জন্য বর্তমান সময়ে সবচেয়ে সংকটের জায়গাটি হয়েছে স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কিছু মানুষের লেখালেখি এবং সেসব নিয়ে মিডিয়ার লাগামহীন দাপাদাপি! ক্রীড়াবিদ, অভিনেতা কিংবা রাজনীতিবিদ যারা কোনদিন বিশুদ্ধ বাংলায় ফেসবুকেও একটি স্টাটাস পর্যন্ত প্রচার করেননি তারা বই মেলাকে কেন্দ্র করে লেখক বনে যাওয়ায় প্রকৃত লেখকগণ অস্তিত্ব সংকটে ডুবছেন। কেননা সস্তা জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে পাঠকের ফ্লো তারা কেড়ে নিচ্ছেন। যে কারনে শুধু লেখক নন বরং প্রকাশকরাও ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হওয়ার মত সীমাহীন দুর্গতিতে পতিত হচ্ছেন! আবার কিছু কিছু প্রকাশনী তাদের স্টলে ভিড় বাড়াতে তৃতীয় ক্যাটেগোররির লেখকদেরকে টার্গেট করছেন। কিছু মানুষ স্ব স্ব ক্ষেত্রে তুমুল সফল বটে কিন্তু তারা যখন সেটাকে পুঁজি করে অন্যের রুজিতে হাত দেয় তখন সেটার বিহিত কী হবে? জানি না! প্রথমা-অনন্যার স্টলে যে উচ্ছ্বাস তার চেয়ে অধিক ভিড় মোস্তাক-তিশা, ডাঃ সাবরিনাদের বইয়ের প্রকাশনীতে! দোষ কারে দেই!
পাঁচ।
কথিত কবিদের দাপাদাপিতে বইমেলায় ছুটির দিনে চাপাচাপি লাগে। এরা যতোটুকু মাতে তার চেয়ে অধিক তাঁতে! কী সাংঘাতিক-বিচিত্র ভঙ্গীমা। বই মেলা সশরীরে যদি কোনদিন বন্ধ হয়েও যায় তবুও যেন কবিদের মেলা বাংলা একাডেমি অব্যাহত রাখে। কবিরা কবিদের দর্শন ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কবিতার কপালে যা হয় হোক! আচ্ছা পাঠক-সর্বশেষ আপনি কী কবিতা পড়েছেন, কার লেখা থেকে পড়েছেন এবং সেটি কবে পড়েছেন? বাংলাদেশের জীবিত কবিদের মধ্যে এখন উল্লেখযোগ্য কে? কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ যথার্থই বলেছেন, ‘কবিদের আড্ডায় একটা গরু আরেকটা গরুকে সিংহ বলে ডাকে!’
ছয়।
এবারের বই মেলায় প্রকাশিত বইয়ের তালিকা বহু দীর্ঘ তাবে পাঠের তালিকা এখনো ১৫/২০শেই আটকে আছে। বই মেলায় বইয়ের আলাপের চেয়ে ভিন্ন আলাপ বেশি হয়। হুমায়ুন আহমেদ/আজাদরা যে ফ্যান বেইজ তৈরি করে গেছেন সেই স্রোত কিঞ্চিত বইছে বটে তবে এ হাল বেহালে ঠেকতে কত সময় নেয়-সেটাই শঙ্কার। পাঠক যে হারে কমছে তাতে বইয়ের প্রকাশ হয়তো কমবে না-তবে শিক্ষিত লেখক আর মানসম্মত রুচিশীল বইয়ের সংখ্যা কমবে বই-বাড়বে না!
তবুও ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার, বাঙালি পাঠকদের এবং বাংলা একাডেমীর বই মেলার হয়েই বেঁচে থাকুক। নির্ধারিত মেয়াদের চেয়েও এবারের বইমেলা দুদিন বাড়ানো হয়েছে! আগ্রহটা মূলত প্রকাশকদের। তবে বই কেনার মানসিকতায় বই পড়ুয়ারা মেলায় এলে তবেই আয়োজন স্বার্থক হবে। কী হবে তো?