সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ১২:২৩ পূর্বাহ্ন

এখানে সস্তায় মরণ মেলে!

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক, একুশের কন্ঠ : আমাদের শৈশবে প্রত্যেক মায়ের একটা করে রেস্টুরেন্ট ছিল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবারগুলো সেখানে তৈরি হতো! হয়তো বাইরে খাওয়ার মত টাকাও আমাদের ছিল না। তবে এখনো মায়ের হাতের রান্না সবচেয়ে মজাদার! ব্যস্ততা অযুহাতে বাসায় রেস্টুরেন্টের খাবার তৈরি হয় না, বাসায় খেয়ে সেটা প্রচার করা যায় না কিংবা বাইরের খাবারে স্বাদও বেশি! সবচেয়ে বড় কথা আমাদের হাতে অঢেল টাকা! তাই মৃত্যুর পেছনে দৌড়াই! অপ্রাপ্ত বয়স্ককে বাইকে কিনে দেই! দুধের শিশুকে দেই মোবাইল! খরচ করার জন্য অভিজাত হোটেল খুঁজি! এতোক্ষণ কুযুক্তিতে ছিলাম। এমন মৃত্যু কীভাবে মানি? এবার আসল কথায় আসি!

ব্যবসায়ীরা সুযোগটা নিয়েছে! রাইজিং ব্যবসাসমূহের মধ্যে ফুড বিজনেস টপে! যেহেতু রেস্টুরেন্টের জন্য আলাদা কাঠামো নির্মানে সংস্কৃতি, নজরদারির কর্তৃপক্ষের জনবল সংকট এবং সর্বোপরি আইন না মানার মানসিকতায় আবাসিক ভবনগুলো রেস্টুরেন্টে বদলে গেছে এবং যাচ্ছে! কাঁচে আবদ্ধ সুন্দর অবয়বে মধ্যেই গ্যাস-সিলিন্ডার পাশাপাশি বসিয়ে বারো-চৌদ্দটি অগ্নিকুন্ডে দিনভর রান্নায় গোটা বিল্ডিং মৃত্যকূপে পরিণত হতে থাকে! সেখানে যে দয়া করে রোজরোজ দূর্ঘটনা ঘটে না সেটাই আমাদের সাতজনমের ভাগ্য! হয়তো কেউ আমাদের কল্যাণে করে গিয়েছিল কোন পূণ্য! পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন আহস্মকি কারবার হয় কি-না জানি না, তবে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া এক বন্ধু অসহায় চোখে তাকিয়ে কৌতুক করে বলেছিল, ‘হায় আফসোস, বাংলাদেশেই তোর জীবনটা কাটাতে হবে!’

শহরের সবচেয়ে বেশি বাড়ছে খাবারের দোকান! যে দেশ আশা করে বৃহৎ পরিসরে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজন্ম বেড়ে উঠবে সে দেশের পাঠাগারকে সম্মৃদ্ধ করতে হয়! শহরে পাঠাঘর বাড়ছে! অথচ পাঠাগার শক্তিশালী হলে তবেই অনেক অনিয়ম আপনা-আপনি শুধরে যাবে। আমরা ভালো খেতে গিয়ে মৃত্যু কিনে আনি! খাবারের মান, কুকুক-বিলাইয়ের বিতর্ক, বাসি-পঁচা হেসেলে রাখা, খাবারের সাথে মরণঘাতী রাসয়নিক মিশ্রিত করা এসব নৈমিত্তিক নীতি! শেষমেশ ৪৬টি জীবনের দাম চুকাতে হলো! এর দায়ভার কেউ কোনদিন নেবে না। মৃত্যুর মিছিল এখানেই থামবে না।! সিলিন্ডার সরানো, সঠিক নিয়মে রেস্টুরেন্টের অনুমতি, ব্যবসায়ের নীতি বিশেষ করে খাবারের মধ্যে মৃত্যু মিশিয়ে দেওয়া-এইসব সহজে বন্ধ হবে? কে বন্ধ করবে?

যে আবাসিক ভবনগুলোতে রেস্টুরেন্টের খাবারের যোগানের মত বিশাল কর্মযজ্ঞ ঘিরে রান্না হয় সেগুলোতে দ্বিপাক্ষিক মহড়া হওয়া জরুরি। মানুষ তো বাঁচার জন্য খায়। খেতে গিয়ে যদি মৃত্যুর সাথে দেখা হয়, আগুনে পোড়ে জীবন তবে মানুষ যাবে কোথায়? নির্মানাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে পথচারীর মৃত্যু হয়, দুই বাসের রেষারেষিতে চাপা পড়ে মানুষের জীবন। চারদিকে নাভিশ্বাস! ছোটবেলা শুনতাম, কেউ খেতে বসলে তাকে বকা দেয়া যায় না, শরীরে হাত দেয়া ঠিক নয়! সেই সুযোগ কতবার রক্ষা পেয়েছি বাবার কবল থেকে! অথচ এখন তো খেতে খেতেই জীবন চলে যায়! মানুষের নীতি-নৈতিকতাহীনতায় যমদূতও কৌশল বদলেছে বোধহয়। থালার খাবারটুকু শেষ করারও সময় দেয় না! অসাধুদের পাপে পুড়ে যায় দেবালয়-ভোজনালয়!

পৃথিবীর সর্বত্রই মৃত্যু অনিশ্চিত! তবে আমাদের কর্মকান্ড-পাপকাজ সেই অনিশ্চিয়তাকে ভীতিতে পরিণত করেছে! বাসে-লঞ্চে চড়লে, ফুটপাত ধরে হাঁটলে, কোথাও একটু বসলেও শঙ্কায় থাকতে হয়, এই বুঝি জীবনের শেষ কারণ এলো! হাসপাতালে হেঁটে হেঁটে প্রবেশ করে মৃত্যুবাহী ট্রলিতে নিথর শুয়ে ফিরতে হয়! খাৎনায় জীবন যায় জীবন যায়, বাপ-দাদার আমলে কেউ কোনদিন এই বাক্য শোনে নায়! মানুষ আসলে কোথায় নিরাপদ? ডাঙায় বাস আর জলে লঞ্চ! বাতাসে আগুন আর আকাশে ফাগুন! রেলের দুর্ঘটনা বাড়ছে, রোগের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু ওষুধ কাজ করছে না! মানুষ যাবে কোথায়? ভেজালের দেশে ভেজাল না হলেই বরং টিকে থাকা দায়! পৃথিবীর কোথাও এমন আত্মঘাতী জাতি পাওয়া যাবে না যারা নিজেরা যা খায় তাতেও ভেজালের বিষ মেশায়! আগুনের ওপর বসে আর অসততায় তৃপ্ত হয়ে হাসে। এখানে সস্তায় মরণ মেলে আর দাফনে দেয় টাকা! কে ঘোচাবে স্বজনহারাদের বুকের জমে থাকা ব্যথা?

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com