মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন
জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃঃ
যৌবন যাদের যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। এ বিশ্বাসে ভ্যান চালক বাবার অভাবের সংসারের হাল ধরতে পাথর ভাঙ্গা শ্রমিক হিসেবে উপার্জনের যুদ্ধে নেমে পড়েন খায়রুল ইসলাম (১৯)। জীবন যুদ্ধের শুরুতেই পাথরের আঘাতে নষ্ট হয় তার ডান চোখ আর হয়ে গেলেন পরিবারের বোঝা। সবল দেহের অধিকারী হলেও যৌবনেই নাম উঠলো প্রতিবন্ধির খাতায়। পাথর শ্রমিক খায়রুল ইসলাম লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের তেলিবাড়ি গ্রামের ভুমিহীন ভ্যান চালক রহিদুল ইসলামের ছেলে।
খায়রুল ইসলাম এ প্রতিনিধিকে জানান, অভাবের সংসারে বাল্যকাল থেকেই বাবার সাথে ভ্যান চালাতে সাহায্য করতেন। কিছু বুঝে উঠার পর ভ্যানের পাশাপাশি কৃষি শ্রমিক হিসেবে দিনমজুরী করতেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বার্ধক্যে পৌছে যান বাবা রহিদুল ইসলাম। বৃদ্ধ বাবা ভ্যান চালাতে অক্ষম হওয়ায় বেশি উপার্জনের আশায় ৫ মাস আগে পাথর ভাঙ্গা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন খায়রুল।
দৈনিক ৩২০ টাকা মজুরীতে কাজ নেন বুড়িমারী এলাকার সোহেল মিয়ার পাথর কারখানায়। সেখানে ৩ মাস ভাল ভাবেই আয়রোজগার চলছিল তার। কাজ চলাকালিন সময় হঠাৎ একদিন একটি পাথর এসে তার ডান চোখে আঘাত করে। এতে গুরুতর আহত হন খায়রুল। সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে পাটগ্রাম হাসপাতালে পরে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানকার চক্ষু চিকিৎসক ডা. টি জামান তাদেরকে জানান, খায়রুলের ডান চোখ নষ্ট হওয়ার পথে। সুষ্ঠ চিকিৎসা না হলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে অপর চোখেও এর প্রভাব পড়বে। তাকে সুস্থ করতে উন্নত চিকিৎষার জন্য ভারতে নিতে হবে। এ কথায় ভ্যান চালক বাবা রহিদুলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কোথায় পাবেন চিকিৎসার এত টাকা। কে দিবে তাকে টাকা, কে করবে সহযোগিতা। নয়তো সারা জিবনের জন্য একটি চোখ হারাতে হবে তার আদরের সন্তান খায়রুলকে।
টাকার অভাবে দিনাজপুরের চিকিৎসকের দেয়া সান্তনা চিকিৎসাই চলছে তার। এখন ডান চোখে দেখতেই পান না খায়রুল। ছেলের চিকিৎসার জন্য হাতে পায়ে ধরে পাথর কারখানা মালিকের কাছে ক্ষতিপুরন বাবদ পেয়েছেন মাত্র ৮ হাজার টাকা। যা দিনাজপুরে থাকতেই তার চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে। এখন সংসারের খাদ্য যোগাতে বাবা ছেলে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমানে ডান চোখের সুস্থতা ছেড়েই দিয়েছেন সৃষ্ঠিকর্তার হাতে।
কোন শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে আহত হলে, পঙ্গুত্ব বরন করলে বা মারা গেলে ওই শ্রমিককে বা তার পরিবারকে ক্ষতিপুরন দেয়ার বিধান থাকলেও সেই শ্রম আইন মানা হচ্ছে না পাটগ্রামের এসব পাথর ভাঙ্গা কারখানায়। খায়রুলের মত অনেকেই কাজ করতে গিয়ে পাথর ভাঙ্গা মেশিনে হাত পা চোখ হারাচ্ছেন। এমন কি পাথরের সিলিকনের কারনে মরন ব্যাধী সিলোকোসিসে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রান হারাচ্ছেন। তাদের কাউকে ক্ষতি পুরন দেয়া হচ্ছে না। এটা আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন হলেও কারোরই মাথা ব্যাথা নেই।
স্থানীয় সুত্র মতে সিলোকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ হয়ে মানবেতর জিবন যাপন করছেন শতাধিক শ্রমিক।
কাউয়ামারী এলাকার সাবেক পাথর শ্রমিক বর্তমান ভ্যান চালক এয়াজ উদ্দিন বলেন, বুড়িমারীর পাথর ভাঙ্গা মেশিনে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই হাত পা হারিয়েছেন। কাউকে ক্ষতিপুরন দেয়া হয় নি। যারা মারা গেছে তাদের পরিবারের কোন খোঁজও নেয় নি কোন কারখানা মালিক।
বুড়িমারী পাথর শ্রমিক সংগঠনের নেতা মমিন উদ্দিন জানান, পাথরে কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক মারা গেছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে মানবেতর জিবন যাপন করছেন। কেউ কোন দিন তাদেরকে ক্ষতিপুরন দেন নি। তবে মালিক পক্ষকে চাপ দিয়ে পাথর শ্রমিকদের ক্ষতিপুরন দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।