বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫, ১১:০৬ অপরাহ্ন

স্ত্রীর কবরের পাশে শায়িত হলেন পলান সরকার

বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি::

পাঠাগারের পাশে স্ত্রীর কবরের কাছে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন একুশে পদক প্রাপ্ত ‘আলোকিত মানুষ’ পলান সরকার।

শনিবার (২ মার্চ) বেলা সাড়ে ১০টায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পলান সরকারের স্ত্রী রাহেলা বেগম (৮৫) মারা যান।

দাফনের আগে সকাল ১০টায় রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত হারুন-অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মরহুম পলান সরকারের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন এই স্কুলের ম্যানিজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন পলান সরকার। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন বাউসা পূর্বপাড়া জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ আবুল বাশার।

জানাজায় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের, রাজশাহী পুলিশ সুপার মো. শহীদুল্লাহ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন রেজা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, সরের হাট এতিমখানার পরিচালক সাদা মনের মানুষ শামসুদ্দিন সরকার, বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় সদ্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. লায়েব উদ্দিন লাবলু, বাঘা পৌরসভার মেয়র আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মেয়র আক্কাছ আলী, বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল, বাউসা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান শফিক সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

জানাজার আগে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহি অফিসার, বাউসা ইউনিয়ন পরিষদসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগন। স্মৃতি চারণ করে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, প্রথম আলোর রাজশাহী প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, প্রতিমন্ত্রীর পিতা শামসুদ্দীন, মরহুমের বড় ছেলে মোজাফ্ফর হোসেন ও পলান সরকার পাঠাগারের সাধারন সম্পাদক হায়দার আলী। বাউসায় পলান স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দেন প্রতিমন্ত্রীর পিতা শামসুদ্দীন। আলোকিত মানুষটির স্মৃতি ধরে রাখতে তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়কে জাতীয় করণের আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।

১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। তার আসল নাম হারেজ উদ্দিন। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তার বাবা মারা যান। আর্থিক টানাপড়নে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয় তাকে।

গতকাল শুক্রবার (১ মার্চ) বেলা ১২টার দিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের পূর্বপাড়া গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। পলান সরকার বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোট-বড় সবার দোরগোড়ায় বই হাতে পৌঁছে দিতেন পলান সরকার। সামাজিকভাবে অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’। পলান সরকার রাজশাহী জেলার ২০টি গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন অভিনব শিক্ষা আন্দোলন। আগ্রহের কারণে ২০০৭ সালে সরকারিভাবে তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়।

নিজের টাকায় বই কিনে তিনি পড়তে দিতেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলা ভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেকদিন একেক গ্রামে গিয়ে বই বিলি করতেন। বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দিতেন। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন ‘বইওয়ালা দুলাভাই’ হিসেবেও।

পলান সরকার ছিলেন বই পাগল মানুষ। ডায়াবেটিস ধরা পড়ায় হেঁটে হেঁটেই তিনি বই বিলি করতেন। একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এই কাজ করেছেন তিনি। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর আগে তাকে নিয়ে আসা হয় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে। এছাড়া তাকে নিয়ে ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’ নামে একটি নাটকও তৈরি হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com