মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫, ১১:০২ পূর্বাহ্ন
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:: প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের সনদ পাইলাম, ঘর পাইলাম না। গরীব মানুষ অন্যের জমিতে একটা ঘর করে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে কষ্টে আছি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের জন্য ইউএনও অফিসে আবেদনের প্রেক্ষিত ঘর বরাদ্দের সনদ পাই কিন্তু সনদ প্রাপ্তির ছয় মাস অতিবাহিত হলেও ঘর পাইনি। আমার জন্য বরাদ্দ ঘর অন্য জনকে দেওয়া হয়েছে। ঘরের জন্য নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে এখন আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি কি শুধু সনদ নিয়ে থাকবো, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পাবো না? কথাগুলো বলছিলেন উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের দিনমজুর ঈমান হোসেন।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার স্বরুপ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় কুড়িগ্রামের নয় উপজেলায় তৃতীয় দফায় ৬’শ ৩১ ভূমিহীন পরিবারকে জমি ও ঘর প্রদান করা হয়। এর মধ্যে উলিপুর উপজেলায় ১’শ ৮০ ভূমিহীন পরিবারকে জমি ও ঘর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর সচ্ছল পরিবারের লোকজন পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের ভূমি কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসনের এর যোগসাজশে পাকা দালানবাড়ির মালিক ও গৃহস্থ কৃষকের মাঝে এসব ঘর দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বঞ্চিত পরিবারের লোকজন। অথচ পাশের ঈমান হোসেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও জমির জন্য আবেদন করে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সনদ পেয়েছেন, কিন্তু ঘর পায়নি।
সরেজমিনে উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের আপুয়ারখাতা গ্রামের আবাসন প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, ভূমিহীনের ঘর ও জমি পেয়েছে ওই গ্রামের শ্যামল চন্দ্র বর্মন। তাঁর বাবার নাম কামিনী কান্ত রায়। শ্যামলের পারিবারিক ১০ শতক আয়তনের বসতভিটায় সেমি পাকা দালান রয়েছে। এখনো রঙের কাজ বাকি। এছাড়াও ৮০ শতক কৃষি জমিতে আমন ধান চাষ করেন। শ্যামল ও তাঁর বাবা একই সংসারে আছেন। এছাড়াও শ্যামলের নিজের নামে রয়েছে ২৫ শতক জমি। শ্যামল চন্দ্র বর্মনের পাশের ঘরটি পেয়েছেন একই গ্রামের বাসিন্দা ধনঞ্জয় কুমার বর্মন। তাঁরও বসতভিটায় আছে সেমি পাকা ঘর। বাবার সাথেই ওই বাড়িতেই থাকেন ধনঞ্জয়। প্রায় এক একরের মত আবাদি জমিও আছে তাঁদের হালে। নিজেদের উৎপাদিত ফসলে সারা বছর সংসার চলে। অথচ তাকেও ভূমিহীন দেখিয়ে এসব আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী বসতবাড়ি ও জমি নেই এমন ভূমিহীন পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়ার বিধান রয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় যদি সেরকম কোন পরিবার পাওয়া না যায় তবে যাদের ১০ শতকের কম জমি আছে তাদের উক্ত প্রকল্পের ঘর দেওয়া যাবে। এছাড়াও নীতিমালার ‘ছ’-তে একই পরিবারের একাধিক সদস্যকে জমি দেওয়া যাবে না উল্লেখ্য থাকলেও মানা হয়নি সে নীতিমালাও। উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের আপুয়ারখাতা গ্রামের খলিলুর রহমান ও তাঁর দুই ছেলেকে দেওয়া হয়েছে তিনটি ঘর ও জমি।
গত বছরের ২৬ এপ্রিল আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীনদের মাঝে দুই কক্ষ বিশিষ্ট এসব ঘর ও জমি হস্তান্তর করা হলেও আসল ভূমিহীনকে ঘর না দিয়ে সচ্ছল ও গৃহস্থ পরিবারের মাঝে ঘর বিতরনের অনিয়মের প্রতিকারের প্রত্যাশা দেখছেন আপুয়ারখাতা গ্রামবাসী।
গৃহহীন শাহের বানুর ছেলে এরশাদুল ইসলাম বলেন, আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করার পর উলিপুর উপজেলার ইউএনও স্যার একদিন এখানে এসে বললেন যাদের ঘর ও জমি নাই তাঁরা আবেদন করলে ঘর ও জমি পাবে। এজন্য আমার মায়ের ঘরের জন্য আবেদন করি। কিন্তু কিছুদিন পর দেখি শ্যামল ও ধনঞ্জয়ের নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমাদের নাম নেই। এই গ্রামে ঈমান হোসেন ও আমার মা শাহের বানু যদি ঘর না পায় তবে আর কারো পাওয়ার যোগ্যতা নাই। শ্যামলের বাড়ির যে গেট সেই গেটের টাকা হইলে হামরা এক শতক জমি ও ঘর করবের পামো। অথচ সরকার ওমাকে ঘর বরাদ্দ দিলো। এখানে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার চালবাজি আছে।
নিজস্ব জমি ও বাড়ি থাকার পরেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর কিভাবে পেলেন জানতে চাইলে শ্যামল জানান, যে জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্প হয়েছে সেই জমিটি আমার পৈত্রিক সম্পত্তি। ব্রিটিশ ও বাষট্টি খতিয়ানে আমাদের ছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালের রেকর্ডের সময় তা সরকারের খাস খতিয়ানে চলে যায়। যা আমরা অবগত ছিলাম না। পরিবর্তীতে এখানে আবাসন প্রকল্প করার সময় জমির পূর্ব মালিক আমরা হওয়ায় ইউনিয়নের তহশিলদার মোহন্ত কুমার সরকার সাথে কথা বলে আবেদন করেছি। ইউএনও স্যার সরেজমিনে এসে দেখে গেছেন। তিনি তহশিলদারকে যেভাবে বলেছেন সেভাবেই আমাকে ঘর ও জমি বরাদ্দ দিয়েছে।
ভূমিহীনদের সনদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিয়ে থাকেন। শ্যামল ও ধনঞ্জয় কিভাবে ভূমিহীনের সনদ পেলেন জানতে পান্ডুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। শনিবার(১৪ জানুয়ারি) বিকেলে পান্ডুল ইউনিয়ন পরিষদে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পান্ডুল ইউনিয়নের পরিষদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, চেয়ারম্যান রংপুরে থাকেন। তিনি পরিষদে মাঝে মাঝে আসেন।
উলিপুর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) কাজী মাহমুদুর রহমান জানান, আমি এখানে নতুন এসেছি। সনদ পেয়েছে ঘর পায়নি এরকম অভিযোগ প্রথম শুনলাম। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য বরাদ্দ। যদি ভূমি মালিক কেউ ঘর পেয়ে থাকে তবে অভিযোগ পেলে আমরা তাঁর ঘরের বরাদ্দ বাতিল করবো।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, সনদ পেয়েছে ঘর পায়নি বিষয়টি দুঃখজনক। ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দ ঘর বিত্তবানরা পেয়েছে এরকম কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমার কাছে নাই। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে বিত্তবান যারা ঘর পেয়েছে তাদের বরাদ্দ বাতিল করে ভূমিহীনদের মাঝে আবার বরাদ্দ দেওয়া হবে। আর উপকার ভোগী বাচাইয়ে যদি কোন অনিয়ম ধরা পরলে যারা এর সাথে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোভন রাংসা বলেন, আমি এই উপজেলায় আসার আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের এসব ঘর ও জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমার কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।