সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:৩০ অপরাহ্ন

বাঘায় গ্রামীন অর্থনীতিতে পরিবর্তন এনেছে “আম”, রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও

আব্দুর হানিফ মিঞা, বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি:: যতদিন যাচ্ছে আম বাণিজ্যে তত জমজমাট হচ্ছে। পাড়া মহল্লার অলিগলি থেকে গ্রামের হাটবাজার সর্বত্রই এখন আমের বাজার। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাঘার আম যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপেও। দুর দুরান্তের অনেকে আসছেন বাঘার আম খেতে। ব্যস্ত সময় পার করছে কর্মসংস্থান হওয়া হাজার হাজার মানুষ। পুষ্টিকর খাবার হিসাবে গরু-ছাগলও মজা করে খাচ্ছে আমের খোসা। রাজশাহীর বাঘার মাটিতে আজও দিব্যি আম জনতার মুখে ফেরে, ‘রাজা নেই, শাহী নেই, রাজশাহী নাম, হাতি নেই ঘোড়া নেই আছে শুধু আম’ আর আম। বাঘার অন্যতম অর্থকরী ফসল আম। আমকেন্দ্রিক বাণিজ্য নিয়ে এখানকার হাট-বাজারসহ গোটা অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সব মিলিয়ে আম নিয়ে চলছে হুলস্থুল কারবার।

আম মৌসুমের উপার্জন দ্বারাই এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ তাদের পরিবারের সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ করে। বাগান পাহারা ও গাছ থেকে আম নামানো শুরু করে শ্রেণি পেশার সব বয়সের মানুষ বিভিন্ন কাজে যুক্ত হন। অনেক নারিরাও ঘরে বসে বাঁশের টুকরি (ঝুড়ি) বানানো, পুরাতন বস্তা সেলাইয়ের কাজসহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েন। বাঁশের টুকরি (ঝুড়ি)’র পাশাপাশি প্লাস্টিকের ক্যারেট (ঝুড়ি) ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন অনেক মানুষ। অনলাইন ভিত্তিক আম কেনা বেচায় যুক্ত হয়েছে ছাত্ররাও। এসব আমের বেশিরভাগ যাচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসের।

উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, টুকরিতে আম ভর্তির কাজে ব্যবহৃত কাগজ, খড়, দড়ি, চট, বিকিবিনি করার জন্য আড়ত খুলে বসেছেন স্থানীয়রা। বাগান থেকে নামানো আম পরিবহন করে বাজারে বা আড়তে পৌঁছে দিচ্ছে মহিষের গাড়ি, ভ্যান, ভটভটি চালকরা। বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর জন্য আড়ৎ থেকে ট্রাকে আম তুলে দিচ্ছেন কুলি শ্রমিকরা। নিয়মিত হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর পাশাপাশি গড়ে ওঠেছে নতুন নতুন অস্থায়ী খাবার দোকান। এ সময়টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে, প্রায় ২ কোটি টাকার উপরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে বিশেষ যত্ন আত্তি করে কৃষকের আম তৈরির কাজ করছেন শ্রমিকরা। দিন-রাত্রি বাগান পাহারা দিয়ে, একজন শ্রমিক,পাচ্ছেন ৪০০ টাকা। গাছ থেকে আম নামানোর কাজ করে প্রতিজন শ্রমিক পাচ্ছেন ৪০০ টাকা। বাগান থেকে আড়তে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে মহিষের গাড়ি, ভ্যান, ভটভটির চালকসহ হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন উপার্জন করছেন। উপজেলার বিভিন্ন আড়ত ও বাজারে ট্রাকে আম লোড দিচ্ছেন কুলি শ্রমিক সংগঠনের লোকজন। মৌসুমে একজন কুলি শ্রমিক আয় করেন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।

ট্রাক বন্দোবস্তকারি শ্রমিকদের সাথে সংশ্লিষ্ট আব্দুর সাত্তার জানান, প্রতিদিন ৪০০’শ থেকে সাড়ে ৪০০’শ ট্রাকে আম লোড করে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ফরিদপুর, কুিমল্লা, ফেনি ও চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে যাচ্ছে। উপজেলায় ছোট-বড় মিলে প্রায় আমের আড়ৎ রয়েছে দেড় শতাধিক। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারি ব্যবসায়ীরা সপ্তাহের দু’দিন উপজেলার বাঘা হাটসহ বিভিন্ন হাট বাজার থেকে শতশত টুকরি আম নিয়ে যাচ্ছেন, যাত্রীবাহি বাসে ও অন্যান্য যানবাহনে।

ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন জানান, মে মাসের শেষ সপ্তাহে আম কেনার জন্য বাঘায় আসতেন বিভিন্ন জেলার আড়ৎদার। এবার করোনার কারণে বাইরের ক্রেতাদের দেখা মিলেছে কম। আমের কম দামে ক্রেতারা খুশি হলেও লোকসান গুনছে বাগান মালিক ও আম ব্যবসায়ীরা।

আড়পাড়া গ্রামের বাগান মালিক আনোয়ার হোসেন পলাশ জানান, করোনা প্রদুভাবে এবার আমের বাজার গত বছরের চেয়েও অনেক কম। গত বছরে বাগানের যে আম ৬৫ লাখ টাকা বিক্রি করেছিলাম। যা দিয়ে পুরো বছরের খরচ ছাড়াও সঞ্চয় করতেন। এবার সেই বাগানে আম ধরেছে গত বছরের চেয়ে বেশী। কিন্তু আমের দাম কম থাকায় সেই একই বাগানের আম ৪৫ লাখ টাকা বিক্রি হতে পারে। তবে দাম বাড়লে এর চেয়ে বেশি বিক্রি হতে পারে।

ব্যবসায়ী ময়েন উদ্দিন জানান, ফরমালিনমুক্ত আম বাজারজাত করণের জন্য গত কয়েকবছর ধরে প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে এবার সঠিক সময়ে জমে উঠেছে আমের বাজার। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে উপজেলার প্রধান বাজারগুলোতে আম নামতে শুরু করে। গোপাভোগসহ অগ্রিম জাতের গুটি আম মৌসুম শুরুতেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে ক্ষিরশাপাত, দুধসর, দুধকমর, কিষানভোগ, গোপাল লাড়ূ, তোতাপরি, ল্যাংড়া ও লক্ষনভোগ (লখনা)সহ বিভিন্ন জাতের আম পুরোদমে বাজারে বিকিকিনি চলছে।

উপজেলার বিভিন্ন আড়ৎ ও হাটবাজারে সাইজভেদে বর্তমানে প্রতিমণ ক্ষিরশাপাত বিক্রি হচ্ছে ১৭০০’শ থেকে ১৮০০’শ টাকা ও ল্যাংড়া ১৩০০’শ থেকে ১৪০০’শ টাকা, লক্ষনভোগ (লখনা) ৬০০’শথেকে ৭০০’শ টাকা এবং বিভিন্ন জাতের গুটি আম ৭০০’শ থেকে ৮০০’শ টাকা মণ দরে। কয়েক দিনের মধ্যে নামবে, মোহনভোগ আড়াজাম ও আমের সেরা ফজলি। সবশেষে আসবে আশ্বিনি আম। যা আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাওয়া যাবে। তবে সামগ্রিকভাবে আমের ফলন হ্রাস পেয়েছে ফজলির। গোপালভোগ, ক্ষিরশাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালি, আড়াজামসহ ভালো জাতের আম গাছের সংখ্যা কম হওয়ায় এগুলোর উৎপাদনও কম হয়েছে।

বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলেন, উপজেলার অর্থনীতিতে আমের ভ’মিকা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে হতাশার কথা হচ্ছে, আম প্রক্রিয়াজাতকরণে কোনো শিল্প গড়ে উঠেনি এখনো। অনেকের কাছে দরবার করা সত্ত্বেও লুপ্তপ্রায় প্রজাতির আমগাছ রক্ষা করার জন্য ম্যাঙ্গো অ্যাম্পোরিয়াম গড়ে তোলা হয়নি।

কৃষি অফিসার শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবার কারণে প্রতিবছর বাড়ছে আমের বাগান। উপজেলায়, ৮ হাজার ৫’শ ৭০ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। হেক্টর প্রতি ১৫ দশমিক ৫৮ মেট্রিক টন আম উৎপাদন নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি জানান, ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতির মাধ্যমে আম চাষ হচ্ছে বলেই দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইতোমধ্যে বাঘা থেকে ১৩ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com