সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:২৯ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার দেশ

ছবি-সংগৃহীত

অনলাইন ডেস্ক:: এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশের ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণের দিক থেকে দেশটি এখন পুরো এশিয়ার শীর্ষে। একসময় যেটি সীমিত আকারে ছিল, তা আজ রূপ নিয়েছে এক অচলাবস্থায়। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, শিথিল নীতি এবং অনিয়ম-দুর্নীতি মিলিয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা অর্থনীতির সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকেই হুমকির মুখে ফেলছে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ননপারফর্মিং লোনস ওয়াচ ইন এশিয়া ২০২৫’ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২ শতাংশ এখন খেলাপি। অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ২০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের তুলনায় এটি ২৮ শতাংশ বেশি। এডিবি সরাসরি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ হলো এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার দেশ।

এডিবি বলছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে ১১ শতাংশ পয়েন্টেরও বেশি। এ ধরনের ঊর্ধ্বগতি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার কোথাও দেখা যায়নি। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলঙ্কা যেখানে ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের হার কমাতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে পরিস্থিতি উল্টো দিকেই গেছে। এমনকি নেপালের মতো ছোট অর্থনীতিও খেলাপি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে শিথিল নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, ঋণ পুনঃতফসিলের অপব্যবহার এবং দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা ব্যাংক খাতকে আজকের এই অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে প্রকৃত চিত্র আড়াল হয়ে থাকলেও, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে, তখন আসল সংকট ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।

ঋণ শৃঙ্খলার পতনের ইতিহাস

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের সমস্যা নতুন নয়। নব্বই দশকের শুরুতে এ খাতেই প্রথম বড় ধরনের খেলাপির সংকট তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানা সময়ে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলেও রাজনৈতিক প্রভাব আর দুর্বল প্রয়োগ ক্ষমতার কারণে তা কার্যকর হয়নি।

২০০০ সালের দিকে খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশের বেশি ছুঁয়ে যায়। পরবর্তীতে পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন এবং নানা ছাড়ের মাধ্যমে কাগজে-কলমে হার কিছুটা কমানো হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ঋণ পুনরুদ্ধার হয়নি। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা নিয়মিত সুবিধা পেতে থাকেন। ফলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরলেও তা ছিল অনেকটা ‘আবরণে ঢাকা বাস্তবতা।

এডিবি’র সর্বশেষ প্রতিবেদন: বাংলাদেশের অবস্থান

২০২৪ সালে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার ২০.২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শুধু খেলাপি বাড়েনি, বরং এক বছরে ১১ শতাংশ পয়েন্টের বেশি বৃদ্ধি নজিরবিহীন।

তুলনায় ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালের মতো দেশও খেলাপি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এডিবি বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে শিথিল নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার। পুনঃতফসিল ও ঋণ নবায়নের অপব্যবহার প্রকৃত চিত্র আড়াল করেছে। কিন্তু এখন বাস্তব তথ্য প্রকাশ হওয়ায় সংকটের প্রকট রূপ সামনে আসছে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা

ভারত কয়েক বছর আগেও খেলাপি ঋণের বড় সংকটে পড়েছিল। তবে ঋণ পুনরুদ্ধার আইন কার্যকর, দেউলিয়া আইন সংস্কার, ব্যাংক পুনর্গঠন এবং তদারকি জোরদার করে দেশটি ধীরে ধীরে ঋণ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ফলাফল—তাদের খেলাপি ঋণের হার নেমে এসেছে ৩.৪ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশে।

পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাও একই পথ ধরে সংস্কার চালিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার পর ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা কিছুটা ফিরিয়েছে। পাকিস্তানেও ঋণ নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

নেপাল তুলনামূলক ছোট অর্থনীতি হলেও ঋণ শৃঙ্খলা ভালো। খেলাপি ঋণ মাত্র ৩-৪ শতাংশের মধ্যে। আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার—ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া—সবগুলোতে দেশেরই খেলাপি ঋণের হার দুই থেকে তিন শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মালয়েশিয়ায় হার সবচেয়ে কম—প্রায় ১.৫ থেকে ২ শতাংশ। এছাড়া চীনে খেলাপি ঋণ গড়ে দেড় শতাংশ, আর দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র ০.২ শতাংশ। কোরিয়ার ব্যাংকিং তদারকি এতটাই শক্তিশালী যে দেশটিকে এশিয়ার সেরা উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়।

কিরগিজস্তান: ছোট অর্থনীতি হলেও খেলাপি ঋণের হার ১২ শতাংশের ওপরে। তবে তা বাংলাদেশের মতো ভয়াবহ নয়।

তুলনামূলকভাবে দেখা যায়—যেখানে সংস্কার হয়েছে, যেমন ভারত, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সেখানে ঋণ সংকট নিয়ন্ত্রণে আছে। আর বাংলাদেশ সংস্কারের অভাব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর চিত্র

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ। তিন মাসে এ ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আর এক বছরে বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা বা ১৫১ শতাংশ।

গত মার্চের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, তখন অনুপাত ছিল ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা করছেন দুটি কারণে-

১. সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নামে-বেনামে যে বিপুল অর্থ ঋণ হিসেবে বের করে নেওয়া হয়েছিল, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।

২. আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঋণ শ্রেণিবিন্যাস করা হচ্ছে, যার ফলে অনেক পুনঃতফসিলকৃত ঋণ এখন খেলাপি তালিকায় পড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, যেসব ঋণ এতদিন নিয়মিত নবায়ন করা হচ্ছিল, তার বড় অংশ আদায় হচ্ছিল না। এবার সেগুলো প্রকৃত অবস্থায় খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় চিত্র ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ আজ এশিয়ার শীর্ষ খেলাপি ঋণের দেশে পরিণত হয়েছে এটি কোনও গৌরবের বিষয় নয়, বরং অর্থনীতির জন্য বড় সতর্কবার্তা। ইতিহাস বলছে, সংস্কার ছাড়া কোনও দেশ খেলাপি সংকট কাটাতে পারেনি। ভারতের মতো সাহসী সংস্কার, কোরিয়ার মতো শক্তিশালী তদারকি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বাংলাদেশকে এই তালিকার শীর্ষ থেকে সরানো সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য হলো, ব্যাংক খাতের সংকট এখন জাতীয় অর্থনীতির সংকট। আগামী সরকার যদি বাস্তব সংস্কারে না যায়, তবে এই সংকট আরও গভীর হবে। আর যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও কঠোর সংস্কার শুরু হয়, তবে বাংলাদেশও একদিন এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগের সরকার বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করেছে। এতে প্রকৃত খেলাপি আড়াল হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সত্যিকারের তথ্য প্রকাশ করছে, তাই আসল সংকট দৃশ্যমান হচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম কড়াকড়ি যথেষ্ট নয়। আইনের কঠোর প্রয়োগ, বিচারব্যবস্থার দক্ষতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ভারতের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে খেলাপি সংকট কাটানো সম্ভব।

ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

এডিবি সতর্ক করেছে যে, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে আগামীতে খেলাপি ঋণের ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ যেহেতু বৈদেশিক বাণিজ্য ও আমদানি নির্ভর অর্থনীতি, তাই এখানে ঝুঁকি দ্বিগুণ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com