শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫১ অপরাহ্ন
আজ মহান মে দিবস। বলার অপেক্ষা রাখে না, পৃথিবীর ইতিহাসে এই দিনটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। এ দিবসটি আমাদের দেশের কৃষকদের জীবনে আর পাঁচ-দশটা দিবসের মতো মনে হয়। কারণ এ দিবস নিয়ে তাদের তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই। তাদের কাছে আসে নেহায়েত ৩০ এপ্রিলের পরের দিন ১ মে, সেই হিসেবে। এই দিনে সরকারি ছুটি থাকে, কিন্তু কৃষকরা জানেন না। এই দিনটা শুধুই তাদের জন্য। তাদেরকেও তাদের কাজকে সম্মান করার জন্য এই দিনের আয়োজন। অথচ তাদের ছুটি নেই, এ দিনেও তাদের ছুটতে হয় মাঠে। ভয়াবহ ভাইরাস করোনার মধ্যেও ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উৎপাদন চাকা সচল রাখতে হচ্ছে।
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কেননা সে সময় তাদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা ছিল না। নামমাত্র মজুরিতে মালিকদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হতেন। আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে সেদিন শ্রমিকরা জীবন দিয়েছিলেন। সেদিন শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। এর প্রতিবাদে ৪ মে হাজার হাজার শ্রমিক ফেটে পড়েছিলেন বিক্ষোভে। সেদিনও পুলিশের গুলিতে শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছিল। আন্দোলন গড়ে তোলার অপরাধে কয়েকজন শ্রমিককে মৃত্যুদন্ডও দেয়া হয়েছিল। এভাবে প্রাণের বিনিময়ে শ্রমিকশ্রেণি কায়েম করেছিল দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। এরপর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
যুগে যুগে দেশে দেশে সমাজে খেটে-খাওয়া শ্রমিকশ্রেণি ও মেহনতি মানুষ দেশ-জাতির উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছে, অথচ অবলীলায় তাদের জীবন চলে গেছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। শ্রমিক নির্যাতন ও শোষণের ওপর গড়ে উঠেছে পুঁজির পাহাড়। অথচ এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, যে কোনো দেশের উৎপাদন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে শ্রমিকরাই বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। আবার শোষণ-বঞ্চন ও নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে শ্রমিকরাই। আমরা বলতে চাই, শ্রমিকদের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য বিষয়। নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকের মর্যদা। কেননা শ্রমিকশ্রেণি সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি এখনো। সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল, শ্রমিকের মৃত্যু হলো, নিখোঁজ ও পঙ্গু হলো, সেই ঘটনায় বারবার শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছিল। বাংলাদেশে শ্রমিকশ্রেণির অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত, তবু পরিতাপের বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না।
নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকার রক্ষা ও দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রামও করেছে বছরের পর বছর। তারা সংগ্রাম করে চলেছে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, নিজেদের দাবি আদায়ের নিমিত্তে। যে কোনো পেশাজীবী মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে কোনো রক্তপাত যে বৃথা যায় না, ইতিহাসে তার অনেক প্রমাণও রয়েছে। শ্রমের মর্যাদা রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে এ পর্যন্ত রক্ত দিয়েছে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ। নিজেদের জীবন দিয়ে তারা তাদের দাবি আদায় করেছে। তবুও শোষকদের কাছে তারা মাথা নত করেনি। এখনো দেশে দেশে শ্রমিক শোষণ চলছে। বাংলাদেশেও শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ।
বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবী কার্যত থমকে গেছে। মানুষ বন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়ছে লাশের সারি। সংক্রমণ থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। হুহু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যু। আর এ সময়েও বাংলাদেশে বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রাখলে তা কতটা উদ্বেগের সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী। প্রায় প্রতি বছর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় অনেকেই মারা যায়। দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যায়, তাদের পরিবারের রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি অকালে মারা যায় তবে ওই পরিবারের যে কী অবস্থা হয় তা সহজেই অনুমেয়। এ কথা মনে রাখতে হবে, শ্রমিকদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। ফলে শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা এবং সামগ্রিক অধিকার নিশ্চিত হোক এমনটি কাম্য।