মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫, ০২:৩৮ অপরাহ্ন

সাভার ও ধামরাইয়ের বায়ুমান বিপদজনক: রাজধানীর দূষণ বাড়াচ্ছে অবৈধ ইটভাটা

স্টাফ রিপোর্টার ॥
দেশের মধ্যে এই প্রথম উপজেলা হিসেবে সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ বা ‘ক্ষতিগ্রস্ত বায়ু এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এই ঘোষণার ফলে সাভারে বায়ু দূষণের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে রাজধানী ঢাকার জনস্বাস্থ্যের ওপর। পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি এক পরিপত্রের মাধ্যমে সাভারের বাতাসে দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করে।

ভয়াবহ দূষণের চিত্র
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, একজন মানুষের জন্য নিরাপদ বাতাসের মান প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম হওয়া উচিত। কিন্তু সাভারের বাতাসে এই মান প্রায় ২০ গুণ বেশি। এমনকি দেশের নিজস্ব নির্ধারিত মান (৩৫ মাইক্রোগ্রাম) থেকেও এখানকার বাতাসের মান প্রায় তিন গুণ খারাপ। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, সাভারের বাতাসে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৬০ দিনের বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত দূষণ থাকে। এর কারণ হিসেবে অবৈধ ইটভাটা ও অন্যান্য শিল্প-কারখানাকে দায়ী করা হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী উপজেলা ধামরাইয়েও একই ধরনের দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই দুই উপজেলায় মোট ২৭২টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে, যার ধোঁয়া ঢাকার বাতাসকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে।

নতুন বিধিনিষেধ ও পদক্ষেপ
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত পরিপত্র অনুযায়ী, বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২-এর বিধি ৫-এর আওতায় সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান কিলন ছাড়া সাভারে সব ধরনের ইটভাটায় ইট পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে ১০৭টি ইটভাটা বন্ধ হয়ে যাবে। একই সাথে, কঠিন বর্জ্য খোলা অবস্থায় পোড়ানো এবং বায়ুদূষণের ঝুঁকি আছে এমন শিল্প-কারখানার অনুকূলে অবস্থানগত ও পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জনস্বার্থে এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। বিশেষ করে, ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া (ব্ল্যাক কার্বন) নাকে মাধ্যমে রক্তে মিশে যাচ্ছে, যা রক্তকে দূষিত করে এবং বিভিন্ন রোগের কারণ হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে যেখানে প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ০.৫-০.৮ মাইক্রোগ্রাম কালো ধোঁয়া থাকে, সেখানে রাজধানীর বাতাসে এর পরিমাণ ৭ থেকে ১১ গুণ বেশি। এই দূষণের কারণে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে এবং অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, “দেশের মানুষের স্বাস্থ্য বিবেচনায় সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে সাভার ও ঢাকা উভয় অঞ্চলের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পরিবর্তন আসবে এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে।” তিনি আরও জানান, শুষ্ক মৌসুমে বাতাস উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হওয়ায় সাভারের দূষিত বায়ু সরাসরি ঢাকায় প্রবেশ করে, যা রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ
আইকিউ এয়ারের মতো বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। ঢাকার বাতাসের মান সূচক প্রায়শই ৩০০-৪০০ এর মধ্যে ওঠানামা করে, যা ‘বিপজ্জনক’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, “রাজধানীর দূষণের জন্য সাভারের পাশাপাশি গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের অবৈধ ইটভাটাও দায়ী।” তিনি প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সাভারকে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং ভবিষ্যতে সব এলাকার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com