বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫, ০৪:২৪ পূর্বাহ্ন

সন্দেহের’ জেরে দুই সহোদর কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা

মো. সামাদ খান, ফরিদপুর প্রতিনিধি ।।
ফরিদপুর: ফরিদপুরের মধুখালীতে একটি উপাসনালয়ে আগুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নির্মাণশ্রমিক দুই সহোদর কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশসহ আহত হয়েছেন আরও অন্তত সাতজন।

বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাতে উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লীতে এ ঘটনা ঘটে।

আহতদের উদ্ধার করে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের শিকার দুই ভাই হলেন-ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের চোপেরঘাট গ্রামের শাহজাহান খানের ছেলে আশরাফুল খান (১৭) ও তার ভাই আশাদুল খান (১৫)।

তাৎক্ষণিকভাবে আহতদের নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, পঞ্চপল্লী গ্রামে একটি মন্দিরে আগুন দেওয়ার খবরে ঘটনার সূত্রপাত হয়। কতিপয় লোকের ‘সন্দেহ’ হয়, এখানে একটি নির্মাণাধীন স্কুলের নির্মাণ শ্রমিকরা আগুন দিয়েছেন। তারা তখন ওই স্কুলের নির্মাণশ্রমিকদের বেদম পিটিয়ে ও ইট দিয়ে থেতলিয়ে গুরুতর আহত করে। এদের মধ্যে দুজন নিহত হয়েছেন।

কে বা কারা সেখানে আগুন দিয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

খবর পেয়ে সন্ধ্যার পর প্রথমে মধুখালী থানার ইউএনও এবং ওসির নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরেও হামলা করে জিম্মি করে রাখা হয়। এ সময় ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সেখানে পৌঁছালে হামলাকারীরা রণমূর্তি ধারণ করে। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফরিদপুর র‍্যাব ১০ ও পুলিশ ফাকা গুলি বর্ষণ করে আটকদের কে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনে।

খবর পেয়ে ফরিদপুর থেকে জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম ঘটনাস্থলে ছুটে যান। প্রায় ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় অবরুদ্ধ থাকার পর আহতদের উদ্ধার করে মুমূর্ষু অবস্থায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এ ঘটনায় সেখানে রিপোর্ট লেখার সময়েও চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই এলাকার অতিরিক্ত র‌্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

অতিরিক্ত নিরাপত্তার স্বার্থে জেলা প্রশাসন ৪ প্লাটুন বিজিবি পাঠাতে বলা হয়েছে। ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন জানান, পাঁচ গ্রাম নিয়ে সেখানে পঞ্চপল্লী অবস্থিত। এলাকাটি হিন্দু বসতি অধ্যুষিত। এর মাঝে কৃষ্ণনগর নামে এক গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজের জন্য সেখানে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিলেন। পঞ্চপল্লীর একদল মানুষ ওই নির্মাণ শ্রমিকদের পিটিয়ে আহত করে নির্মাণাধীন স্কুল ঘরে আটকে রাখে। স্কুল ভবনের দরজা, জানালা, গ্রিল ভেঙে ফেলে তারা।

এ সময় বাইরে থেকে কেউ ওই গ্রামে যেতে পারেনি। সেখানে একটি কালী মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। তপতি মন্ডল নামে ওই গ্রামের এক নারী জানান, তিনি মায়ের ঘরে (কালীমন্দির) সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছিলেন, তখন শ্রমিকরা জানালা দিয়ে দেখছিলেন কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা। তারপর আমি বাড়ি গিয়েছিলাম ঘোষি নিতে। তখন ওরা (শ্রমিকরা) রড ওঠানামা করতেছিল আর নিজেরাই বকাবাজি করতেছিল। তারপর আমি চিৎকার শুনতে পাই। এগিয়ে গিয়ে দেখি, মা একদম পুড়ে গেছে। তারপর লোকজন জড়ো হয়ে গেল। এই যা। তারপর কী হলো তা তিনি দেখেননি।

এছাড়া কারা মন্দিরে আগুন দিয়েছে তাও তারা কেউ দেখেননি বলে জানান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফরিদপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাজবাড়ী জেলা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ আনা হয়েছে পরিস্থিতি মোকাবিলায়। পাশাপাশি ফরিদপুর থেকে র‍্যাব সেখানে পৌঁছাই। র‍্যাবের অধিনায়ক ল্যান্স কমান্ডার কে এম শাইখ আক্তার বলেন ঘটনা জানার পর পরই আমি আমার ফোর্স সহ ঘটনা স্হলে পৌছে পুলিশের পাশাপাশি অভিযান পরিচালনা করে পরিস্থিতি সাভাবিক আনতে পেরেছি, থেমে থেমে সেখানে ফাঁকা গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ঘটনাস্থলের কাছে অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, এখানে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিলেন। উত্তেজিত জনতা ভেতরে ঢুকে তাদের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে ও ইট দিয়ে থেতলিয়ে গুরুতর আহত করে। খবর পেয়ে মধুখালী থানার ওসি ফোর্সসহ এখানে আসে। তাদের সঙ্গে মধুখালী উপজেলার ইউএনও ছিলেন। তারা এখানে এসে উত্তেজিত জনতার হাতে আটকে পড়েন। খবর পেয়ে আমরা ফরিদপুর থেকে অতিরিক্ত ফোর্সসহ এসে তাদেরসহ আহতদের উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে ফরিদপুরে হাসপাতালে পাঠাই।

তিনি বলেন, এখনো (রাত ১টার দিকে) আশেপাশে থেকে অনেকে লাইট মারছে, চিৎকার করছে। আমরা সারারাতই পাহারা দেব।পুলিশ সুপার বলেন, এ ঘটনায় অনেক পুলিশ আহত হয়েছেন। তাদের দিকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারা হয়েছে। আমরা সারারাতই পাহারা দেব। গ্রামবাসীসহ সবাইকে অনুরোধ করবো কেউ যেন আইনকে নিজের হাতে তুলে না নেয়। বিষয়টি ঢাকা থেকে আইজি মহোদয় নিজেও সবসময় খবরা-খবর রাখছেন।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ঘটনাস্থল থেকে সাংবাদিকদের জানান, এখানে পঞ্চপল্লী গ্রামে একটি কালী মন্দিরে আগুন দেওয়ার খবরে ঘটনার সূত্রপাত। গ্রামবাসীর সন্দেহ এখানে একটি নির্মাণাধীন প্রাইমারি স্কুলের নির্মাণ শ্রমিকরা আগুন দিয়েছেন। তারা এই শ্রমিকদের বেদম পিটিয়ে ও ইট দিয়ে থেতলিয়ে গুরুতর আহত করে। তাদের উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। সবার অবস্থাই খারাপ।

তিনি বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ আহতদের উদ্ধার করতে এলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। তখন কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে। রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পঞ্চপল্লী গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, সকালে এখানে বিজিবি মোতায়েনের জন্য চার প্লাটুন বিজিবি চাওয়া হয়েছে। মধুখালী ছাড়াও শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিজিবি মোতায়েন করা হবে। কাউকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীত বিনষ্টের সুযোগ দেওয়া হবে না।

কোতোয়ালি থানার ওসি হাসানুজ্জামান এ ঘটনায় দুইজন নিহতের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজনকে আনা হয়। এরমধ্যে দুইজন মারা গেছেন। নিহত একজনের নাম আশরাফুল। বাড়ি মধুখালীর নওপাড়া ইউনিয়নের চোপের ঘাট গ্রামে। এ ঘটনায় আহত আরো তিনজনকে মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com