সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:০১ পূর্বাহ্ন
মুজিবুর রহমান বাবু, ই-কণ্ঠ টোয়েন্টিফোর ডটকম ॥ শ্রীলঙ্কা দ্রুত গতিতে ব্যাটিং করে মাত্র ৩ ওভারেই ২৯ রান তুলে নিয়েছেন দুই ওপেনার ওশাদা ফার্নান্দো ও দিমুথ করুনারাতেœ। লক্ষ্য ছিল একেবারেই কম মাত্র ২৯ রান। স্রেফ ৩ ওভারেই সেই রান ছুঁয়ে ফেলল শ্রীলঙ্কা। মিরপুর টেস্ট ১০ উইকেটে হেরে ১-০ ব্যবধানে সিরিজও হারল বাংলাদেশ। ব্যাটিং ব্যার্থতায় ১০ উইকেটে হার বাংলাদেশের।
শুক্রবার ২৭ মে টেস্টের পঞ্চম দিনে দেড় সেশনেরও বেশি সময় আগে বাংলাদেশকে লঙ্কানরা যেন স্রেফ উড়িয়ে দেয়।
ওশাদা ফার্নান্দো খেলেন টি-টোয়েন্টি মেজাজে। মাত্র ৯ বলে ৩ চার, ১ ছয়ে করেন ২১ রান। আরেক ওপেনার দিমুথ করুণারতেœ ৯ বলে ৭ রান করেন। দুজনেই অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন।
বাংলাদেশের মাটিতে এখন পর্যন্ত চারটি টেস্ট সিরিজ খেলে চারটিতেই জিতেছে দলটি। তবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই সিরিজের গুরুত্ব অনেক।
বাংলাদেশের হারের চিত্রনাট্য লেখা হয় চতুর্থ দিন শেষ বিকালে। শ্রীলঙ্কার লিড ছিল ১৪১ রানের। স্বাগতিক ব্যাটসম্যানদের কাজ ছিল ক্রিজে টিকে থাকা। চারটি সেশন কাটিয়ে দিতে পারলে গল্পটা ভিন্ন হতো। তা আর হলো কই! দুই পেসারের তোপে শেষ বিকেলে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় বাংলাদেশের টপ অর্ডার। ২৩ রানে নেই ৪ উইকেট। কোনোমতে দিন শেষ করেন মুশফিকুর রহিম-লিটন দাস।
অনেকে স্বপ্ন দেখতে থাকেন, প্রথম ইনিংসের মতো মহাকাব্য লিখবেন তারা। সবসময় কি আর এক যায়? পঞ্চম দিন সকালেই ফেরেন মুশফিক (২৩)। এরপর সাকিব আল হাসান ও লিটন প্রতিরোধ গড়েন। তারা শধু হারটাই বিল¤॥^ করেছেন, ইনিংস ব্যবধানে হার থেকে বাঁচিয়েছেন। দুজনে প্রথম সেশন কাটিয়ে দেন দারুণ খেলেই। তাদের ব্যাটে শতাধিক রানের জুটিও দেখে বাংলাদেশ। দুজনেই ফিফটি করেন। কিন্ত দ্বিতীয় সেশনে ভাগ্যদেবী যে অন্য কিছু লেখে রেখেছেন।
সব শঙ্কা উড়িযে সময়মতো সফরে এসেই দলটির অধিনায়ক দিমুথ করুনারতেœ জানিয়েছিলেন, তারা মাঠের খেলায় মনোযোগী হয়ে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কিছু উপহার দিতে চান। সেটা তারা বাস্তব করেছেন, মিরপুর টেস্টে ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানে স্বাগতিক বাংলাদেশকে হারিয়ে দিয়েছেন শুক্রবার। আর এতে ১-০ ব্যবধানে সিরিজের ট্রফি জিতে দলটির উইকেটরক্ষক ব্যাটার নিরোশান ডিকভেলা জানালেন, আমরা সবকিছু পেছনে ফেলে এই সিরিজ জিততে এসেছিলাম এবং এটা অবশ্যই এখন শ্রীলঙ্কার জন্য ইতিবাচক বিষয় হবে।
অপরদিকে, বাংলাদেশ দল আর অধিনায়ক মুমিনুল হক পুরোপুরি উল্টো। নিজেদের মাটিতে চট্টগ্রামে প্রথম টেস্ট ড্রয়ের পর মিরপুরে মোক্ষম সুযোগ সিরিজ জয়ের এমনটা জানিয়ে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রথম ইনিংসে বিপর্যয় কাটিয়ে দারুণ ব্যাটিং করলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬৯ রানে গুটিয়ে হয়েছে চরম ভরাডুবি। এজন্য কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো জানিয়েছেন, টেস্ট ক্রিকেটের পুরো সিস্টেমেই পরিশুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।
চট্টগ্রামের সিরিজের প্রথম ম্যাচে সমানে সমান লড়ে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। মিরপুরে জিতে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের বড় সুযোগ দেখছিলেন অধিনায়ক মুমিনুল হক। কিন্তু ভয়াবহ ব্যাটিং ব্যর্থতায় মিলেছে ১০ উইকেটের বিব্রতকর পরাজয়।
লিটন দাস ও মুশফিকুর রহিমের লড়াকু সেঞ্চুরিতে প্রথম ইনিংসে ৩৬৫ রানের সংগ্রহ পেয়েছিল বাংলাদেশ। জবাবে সেঞ্চুরি হাঁকান অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ ও দিনেশ চান্দিমাল। অলআউট হওয়ার আগে শ্রীলঙ্কা পায় ৫০৬ রানের সংগ্রহ, লিড দাঁড়ায় ১৪১ রানের।
দ্বিতীয় ইনিংসেও ভয়াবহ ব্যর্থতার পরিচয় দেন স্বাগতিক দলের ব্যাটাররা। সাকিব আল হাসান ও লিটন দাসের ফিফটির পরও ১৬৯ রানের বেশি করতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে মাত্র ২৯ রানের লক্ষ্য পায় শ্রীলঙ্কা। ওশাদার ৯ বলে ২১ রানের ঝড়ে তিন ওভারেই ম্যাচ জিতে যায় শ্রীলঙ্কা।
গতবছর শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েও প্রথম ম্যাচ ড্র করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু পরের ম্যাচ হেরে যাওয়ায় খোয়াতে হয় সিরিজ। এবার ঘরের মাঠেও হলো একই ফলের পুনরাবৃত্তি। এ নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে টানা তিন সিরিজে এক ম্যাচ ড্র ও অন্যটি হারলো টাইগাররা।
এর আগে টপঅর্ডারের ধারাবাহিক ব্যর্থতায় চতুর্থ দিন বিকেলে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২৩ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। শেষ দিকে লিটন ও মুশফিক মিলে ৩.৫ ওভার কাটিয়ে দেন নির্বিঘ্নে। বাংলাদেশ ৩৪ রানে ৫ উইকেট নিয়ে দিনের খেলা শেষ করে।
প্রথম ইনিংসের মতো আবারও লিটন-মুশফিকের কাঁধে বর্তায় বড় দায়িত্ব। সেই আত্মবিশ্বাস থেকে আজকের দিনের শুরুতেও ইতিবাচক খেলতে থাকেন মুশফিক। শুরুতে বেশ আক্রমণাত্মক ফিল্ড সাজায় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু লিটন-মুশফিকের সাবলীল ব্যাটিংয়ের কারণে খানিক রক্ষণাত্মক হয়ে যায় তারা।
আসিথা ফার্নান্দোর ওভারে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকান মুশফিক। আসিথার তুলনায় কাসুন রাজিথার বোলিং ছিল অধিক নিয়ন্ত্রিত। অফস্ট্যাম্পের বাইরে থেকে হালকা মুভমেন্টের বেশ কিছু ডেলিভারিতে লিটনের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেন তিনি।
ইনিংসে ১৯তম ওভারে তো রাজিথার বলে লিটনকে কট বিহাইন্ডই দিয়ে বসেছিলেন আম্পায়ার। তবে রিভিউ নিয়ে নিজের উইকেট বাঁচান লিটন। রাজিথার পরের ওভারে মুশফিক পারেননি নিজেকে বাঁচাতে। অফস্ট্যাম্পের বাইরে লেন্থ ডেলিভারিটি হালকা স্কিড করে সোজা ঢুকে যায় স্ট্যাম্পে।
দ্রুত ব্যাট নামিয়েও বোল্ড হওয়া থেকে বাঁচতে পারেননি মুশফিক। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ৪ চারের মারে ২৩ রান। মুশফিক ফিরে যাওয়ার খোলসে ঢোকার বদলে আক্রমণে যায় বাংলাদেশ।
চাপ দূর করার জন্য লঙ্কানদের দুই মূল বোলার রাজিথা ও আসিথার বিপক্ষে পাল্টা আক্রমণ করেন সাকিব-লিটন। তাই বলে বাড়তি ঝুঁকি নেননি তারা। অফস্ট্যাম্পের বাইরে হাত খোলার মতো ডেলিভারিগুলোকে সীমানাছাড়া করেছেন এ দুজন।
রাজিথার করা ২৫তম ওভারে তিনটি বাউন্ডারি হাঁকান সাকিব। তিনটিই ছিল অফস্ট্যাম্পের বাইরে ফুল লেন্থের ডেলিভারি। হাত খুলে কভার দিয়ে চালিয়ে দেন সাকিব। সেই ওভার পর রাজিথাকে আক্রমণ থেকে সরিয়ে নেন লঙ্কান অধিনায়ক।
বাঁহাতি স্পিনার প্রবীণ জয়াবিক্রম নিয়ন্ত্রিত বোলিং করে খানিক ভয়ের কারণ হয়েছেন। তবে লিটনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের কারণে সফলতার দেখা পাননি এ তরুণ স্পিনার। আসিথার ওভারে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৩০ ওভারের ভেতরেই দলীয় শতরান পূরণ করে নেন সাকিব-লিটন।
চট্টগ্রাম টেস্টের একমাত্র ইনিংসে খাটো লেন্থের ডেলিভারিতে পরাস্ত হয়েছিলেন সাকিব। তাই এবার আক্রমণাত্মক সাকিবের বিপক্ষে একের পর এক বাউন্সার মারতে থাকেন আসিথা। এবার বাউন্সারগুলো ছেড়ে ছেড়ে খেলতে থাকেন সাকিব। হতাশ হয়ে আসিথাকেও সরিয়ে নেন করুনারাতেœ।
লিটন-সাকিবের জুটিতে ৬০ রান পেরিয়ে যাওয়ার পর দিনের ২১ ওভার শেষে দুই প্রান্তেই স্পিন আক্রমণ শুরু করে শ্রীলঙ্কা। একপাশে রমেশ মেন্ডিস ও অন্যপাশে জয়াবিক্রমের চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েন সাকিব ও লিটন। সাকিবের অফস্ট্যাম্পের আশপাশে ক্ষত জায়গা তৈরি হওয়ায় তার জন্য কাজটা সহজ ছিল না।
মোসাদ্দেককে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন রমেশ মেন্ডিস। প্রথম ইনিংসে শূন্যের পর এই ইনিংসে সাত রান করেছেন তিনি। পরের ওভারেই পরপর দুই বলে তাইজুল ইসলাম ও খালেদ আহমেদকে আউট করে বাংলাদেশকে গুটিয়ে দেন আসিথা।
সবমিলিয়ে ৫১ রান খরচায় ৬ উইকেট নেন তিনি। যা তার ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার। এছাড়া রাজিথা দুই ও রমেশ নিয়েছেন এক উইকেট।
বাংলাদেশ দলের সেটা হয়নি। প্রথম ইনিংসে ২৪ রানেই ৫ উইকেট হারানোর পর মুশফিক অপরাজিত ১৭৫, লিটন ১৪১ রান করেছিলেন বলেই বিপর্যয় এড়িয়েছে। টপঅর্ডারদের চরম ব্যর্থতার পরেও তাই প্রথম ইনিংসে ৩৬৫ রান করে বাংলাদেশ।
আর দারুণ ব্যাটিংয়ে ৫০৬ রান করেছে লঙ্কানরা। মিরপুরে সাধারণত প্রথম ইনিংস শেষে লিড নিতে পারলেই জয় আসে। আগের ১৯ টেস্টের ফলাফলে ১৬ বারই সেই ঘটনা সাক্ষী দিচ্ছে এমনটাই। এবারও লঙ্কানরা ১৪১ রানের লিড নিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে।
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৩৬৫
শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস: ৫০৬
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ৫৫.৩ ওভারে ১৬৯
শ্রীলঙ্কা ২য় ইনিংস: ৩ ওভারে ২৯/০
বাংলাদেশের ১০ উইকেটে হার
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস ॥ (আগের দিন ৩৪/৪) ৫৩.৩ ওভারে ১৬৯ (মুশফিক ২৩, লিটন ৫২, সাকিব ৫৮, মোসাদ্দেক ৯, তাইজুল ১, ইবাদত ০*, খালেদ ০; রাজিথা ১২-৫-৪০-২, আসিথা ১৭.৩-৫-৫১-৬, জয়াবিক্রমা ১৩-০-৪৭-০, রমেশ ১১-২-২০-১, ধনাঞ্জয়া ২-০১০-০)
শ্রীলঙ্কা ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ২৯) ৩ ওভারে ২৯/০ (ওশাদা ২১*, করুনারতেœ ৭*; তাইজুল ১-০-১৬-০, সাকিব ১-০-৭-০, ইবাদত ১-০-৫-০)