মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫, ১১:২৭ অপরাহ্ন
বাগেরহাট প্রতিনিধি ॥ বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নের পিসি ডেমা গ্রামের শতাধিক পরিবার মাছ চাষের ওপর নির্ভরশীল। তবে মাছ চাষে লোকসান হওয়ায় চলতি বছর প্রথম বারের মতো তারা ধান চাষ করেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। ভালো ফলনেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের কপালে।
বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাল প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় ধান নৌকায় করে নিয়ে যেতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে শ্রমিক দিয়ে নিতে হচ্ছে ফসল। এতে ব্যয় বাড়ছে কৃষকদের। তাই সরকারি খালগুলো দ্রুত দখলমুক্ত করার দাবি জানান কৃষকরা।
সরেজমিনে ডেমার নলবুনিয়া ও ছোট নলবুনিয়া বিলে দেখা যায়, ভোর থেকেই মাঠজুড়ে কর্ম কৃষক। কেউ ধান কাটছেন, কেউ আবার ধান বেঁধে রাখছেন, বাঁধা শেষে একদল সেই আঁটি বাঁধা ধান মাথায় তুলে নির্দিষ্ট গন্তব্যে রওনা হয়েছেন।
অন্যদিকে বিলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বারই, কুমোরমারা, মোগোরদাড়া খাল দখল করে রেখেছেন প্রভাবশালীরা। তাদের এই দখলের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা। তবে শুধু এই তিনটি খালই নয়, ইউনিয়নের বেশির ভাগ খালেই বাঁধ দিয়ে লবণ পানি ঢুকিয়ে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা।
কৃষি বিভাগ বলছে, এই ইউনিয়নে ২৪০০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হলেও বোরো আবাদ হয় মাত্র ৩০০ হেক্টর জমিতে। লবণ পানি প্রবেশ বন্ধ করতে পারলে ২৪০০ হেক্টর জমিতেই বোরো আবাদ সম্ভব।
স্থানীয় কৃষক শেখ শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা দরিদ্র কৃষকরা ধান চাষ করতে চাই। কিন্তু খালগুলো বেড়িবাঁধ করে পানি ও পানিপথ আটকে রাখার কারণে আমাদের চাষাবাদে খুব সমস্যা হয়। এক দিকে ধান চাষের সময় পানির সমস্যা, অন্যদিকে ধান কেটে বাড়ি পর্যন্ত নিতেও অসুবিধা। আমরা চাই দ্রুত যেন এসব খাল উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক বলেন, আমরা শুধু ফসলই পাইছি। কিন্তু ফসল নিয়ে যেতে আমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। খাল যদি উন্মুক্ত থাকত তাহলে নৌকায় ধান নিতে খরচ হতো ১০০ টাকা। এখন শ্রমিক দিয়ে নিতে ব্যয় হচ্ছে হাজার টাকা। তাহলে আমাদের আর লাভ কী হলো?
শেখ কবীর নামে এক চাষি বলেন, মাছ চাষে লোকসানের পর কৃষি সমবায় সমিতি করে আমরা এ বছর ধান চাষ শুরু করি। উৎপাদনও ভালো হয়েছে। কিন্তু আমাদের পানি পেতে খুব অসুবিধা হয়েছে। এখন পথ-ঘাট না থাকায় ধান নিয়ে যেতে ভোগান্তি হচ্ছে। খাল যদি উন্মুক্ত থাকত, আমরা খুব সহজেই ফসল গোলায় তুলতে পারতাম।
কৃষক মো. এনামুল শেখ বলেন, এবার তিন বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। প্রতি বিঘায় আমার প্রায় ১৭ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। ধানের ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। ন্যায্য মূল্যে যদি ধান বিক্রি করতে পারি, তাহলে লাভ হবে আশা করি।
শেখ আসাদুজ্জামান বলেন, বাগদা চিংড়ি চাষে ভাইরাস আর মড়কে শুধু লস আর লস। আর চিংড়ি চাষে আমাদের ৮ মাস বসে থাকা লাগত। তাই আমরা বোরো মৌসুমে ধান চাষের সিদ্ধান্ত নেই। এরপর কৃষি সমবায় সমিতি করে ধান চাষ করেছি। যে জমি আট মাস পড়ে থাকত সেই জমিতে আজ সোনার ফসল হাসছে। আশা করি বিঘা প্রতি আমাদের ৭০ থেকে ৮০ মণ ধান উৎপাদন হবে।
ডেমা ইউনিয়ন কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ তানজীম তানজু বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে মাছ চাষে আমাদের ক্ষতি হচ্ছিল। ২০১৯ সালে আমরা কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি করে এলাকার চাষিদের একত্রিত করি। চলতি বছর সবার ঐক্যমতের ভিত্তিতে শতাধিক চাষি ধান চাষ করি। সবারই ফলন ভালো হয়েছে। তবে পানির সমস্যা রয়েছে আমাদের। সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আমাদের অনুরোধ, গরিব মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে অন্তত খালগুলো দখলমুক্ত করে দেওয়া হোক।
বাগেরহাট সদর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোল্লা আব্দুল হাই বলেন, ডেমা ইউনিয়নে গত তিন-চার বছর ধরে বোরো আবাদ হচ্ছে। গত বছর ৬০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হলেও চলতি বছর স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, কৃষি বিভাগ ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় বেশ কিছু জমিতে লবণ পানি প্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। ফলে ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ফলনও বেশ ভালো হওয়ায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছে।
তবে এই ইউনিয়নে ২৪০০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়। যদি প্রশাসন উদ্যোগ নেয় ও সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লবণ পানি প্রবেশ বন্ধ করা যায়, তাহলে এই এলাকার ২৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ সম্ভব হবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, সরকারি খাল দখল করে মাছ চাষ সম্পূর্ণ বেআইনি। সদর উপজেলার ডেমায় খাল দখল ও কৃষকদের চাষাবাদে সমস্যার বিষয়টি জেনেছি। ঘটনা সত্য হলে খুব শিগগিরই দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা ও খাল উন্মুক্তের আশ্বাস দেন তিনি।