রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৭:২১ অপরাহ্ন

প্রতিদিন কমছে কৃষিজমি, ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরী

মিরন খন্দকার, স্টাফ রিপোর্টার : প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও গড়ে উঠছে নতুন নতুন হাট-বাজার ও কলকারখানা। কোথাও নির্মাণ হচ্ছে বসতবাড়ি, ইটভাটা, নান্দনিক রিসোর্ট বা পিকনিক স্পট।

এসব করতে গিয়ে আশঙ্কাজনক হারে কমছে আবাদি জমি। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। আবার প্রতি বছর কয়েক লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। এতে ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ বাড়ছে। এ অবস্থায় কৃষিজমি রক্ষায় এখন থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

যত্রতত্র হাট-বাজার, শিল্পকারখানা ও বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করে ভূমির সঠিক ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনায় বলেছেন, চাষযোগ্য জমিতে (তিন ফসলি ও দোফসলি) কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কোনো বাড়িঘর তৈরি করা যাবে না।। অথচ ক্রমাগত কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে, কৃষি উৎপাদনের ওপর দেশের অর্থনীতির ভালোমন্দ নির্ধারিত হয়। অথচ জলবায়ুর প্রভাবে নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, নগরায়ণ, ইটভাটা, শিল্পকারখানা, বসতভিটা, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ও যত্রতত্র বসতি স্থাপনের কারণে সারা দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় দিনে-রাতে ভেকু দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কাটার মহোৎসবও চলছে। অনেকেই মাটি বিক্রি করে জলাশয় করছে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কৃষিজমির পরিমাণ যে হারে কমছে, তাতে অচিরেই কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কৃষিজমি ভরাটের ফলে প্রতিদিন মোট কৃষিজমি কমছে ৯৬ বিঘা। তামাক চাষের কারণে প্রতিবছর কয়েক হাজার একর কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে।

কৃষিজমি কমা ও করণীয় বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘কৃষিজমি কমছে এটা বাস্তবতা। না কমার জন্য নীতিমালাও আছে। বাস্তব প্রয়োজনে শিল্পকারখানার জন্য জমি দিতে হয়। জনসংখ্যাও যেমন বাড়ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার ঘরবাড়ি করতে হয়, বিভিন্ন কিছু নির্মাণ করতে হয়, সব মিলে কৃষিজমি কমছে। নগরায়ণ করতে গেলেও কৃষিজমি নষ্ট হয়।’ ভূমির জন্য পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বলেন এই কৃষি অর্থনীতিবিদ।

ড. শামসুল আলম বলেন, ‘দোফসলি জমি কোনো অবস্থায়ই যেন অন্য কাজে ব্যবহার করা না যায় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, মনিটর করতে হবে। যে জমি আছে সেখানে উৎপাদন বাড়ানোর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদন হার বাড়াতে হবে। কৃষিকে ক্রমান্বয়ে গ্রিনহাউসে নিয়ে আসতে হবে। কৃষির আধুনিকায়নে মনোযোগী হতে হবে। পর্যায়ক্রমে কৃষিকে অত্যাধুনিক কৃষিতে নিয়ে যাওয়া, উৎপাদন বাড়ানোয় মনোযোগী হতে হবে। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব থেকে নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়ার মধ্যে অর্থাৎ প্লাস্টিক হাউসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।’

এতে জমি কমলেও সুফল মিলবে বলে মনে করেন তিনি। সাবেক এই পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে সব করতে হবে। গ্রামেও পরিকল্পিত দোতলা, তিন তলা মানে ঊর্ধ্বমুখী ঘরবাড়ি করতে হবে। যেখানে সেখানে ঘরবাড়ি করা যাবে না, এটা একেবারেই বন্ধ করতে হবে। গ্রামে, উপজেলার জন্য আবাসন পরিকল্পনা থাকতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ কৃষিশুমারিতেও দেখা গেছে, কৃষিজমি কমার তথ্য। বিবিএস সবশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ‘কৃষিশুমারি-২০১৯’ জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ১১ বছরে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ৪ লাখ ১৬ হাজার একর। ২০০৮ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার একর জমি। ২০১৯ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর।

মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ‘বাংলাদেশের কৃষিজমি বিলুপ্তির প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি বছর ৬৯ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ কাজের কারণে প্রতি বছর ৩ হাজার হেক্টর জমি হারিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি-২০১০ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন-২০১০ অনুসারে কৃষিজমি কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা হচ্ছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন।

ভূমিসচিব মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রীও অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের দোফসলি-তিন ফসলি জমি যাতে ব্যবহার না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের কৃষিজমি সুরক্ষা আইনটি এখনো খসড়া হিসেবে আছে, এখানে কৃষিজমিকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে এটি চূড়ান্ত হলে কৃষিজমি রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।’ আইনটি চূড়ান্ত করতে কার্যক্রম অব্যাহত আছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘সফটওয়্যারের মাধ্যমে আমরা একটা কার্যক্রম করছি, জোনিং করছি। এটা করলে কোথায় কোন জমি কী হচ্ছে তা দেখতে পারব।

’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ভূমির মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এখন ৮৮ লাখ ১৭ হাজার ৯৩৫ হেক্টর; যা ২০২২ সালে ছিল ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ২৬৬ হেক্টর। ভূমি জরিপ অধিদফতরের তথ্যমতে, ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর; যা বর্তমানে নেমে এসেছে ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা উৎপাদনে গুরুত্ব দিচ্ছি। এটা ঠিক, কৃষিজমি কমছে এজন্যই আমরা অধিক উৎপাদনে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী দোফসলি-তিন ফসলি জমি কখনো অকৃষিতে পরিণত না করতে বলেছেন। এটি জাতীয় পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক বিষয়।’ কত শতাংশ হারে কমছে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘আসলে আমরা মনে করি ১ শতাংশ হারে কমছে।’

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Titans It Solution