মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:০৭ পূর্বাহ্ন

পদ্মা সেতুর প্রভাবে পেশা বদল হচ্ছে অনেকের

বরিশাল প্রতিনিধি,ই-কণ্ঠ টোয়েন্টিফোর ডটকম॥ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক মাস পার হতে না হতেই চরম যাত্রী সঙ্কটের মুখে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের জনপ্রিয় দিবা গ্রীন লাইন সার্ভিস। ভাড়া কমিয়েও যাত্রী না পাওয়ায় ঢাকা-বরিশাল আকাশ পথে ফ্লাইট পরিচালনা স্থগিত করেছে বেসরকারী বিমান পরিবহন সংস্থা নভোএয়ার।

ভাড়া কমিয়েও যাত্রী পাচ্ছেন না বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের চিরচেনা বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে। একদিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি অপরদিকে চরম যাত্রী সঙ্কটের কারণে ব্যয়ের টাকাও উঠছে না লঞ্চ মালিকদের। ফলে রোটেশন প্রথায় লঞ্চ পরিচালনার কথা ভাবছেন বিলাসবহুল লঞ্চগুলোর মালিকরা।

নৌ ও আকাশ পথে চরম যাত্রী সঙ্কটের মাঝে পদ্মা সেতুর বদৌলতে ভাগ্য খুলেছে পরিবহন মালিকদের। তারা মহাধুমধামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে কোন না কোন বিলাস বহুল পরিবহন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর প্রায় অর্ধশতাধিক নতুন পরিবহন যুক্ত হয়েছে এই রুটে। আরও কয়েকটি বেসরকারী কোম্পানির বিলাস বহুল পরিবহন এ রুটে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

বরিশাল থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছে যাচ্ছে এসব পরিবহনগুলো। ফলে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা সকালে রওনা হয়ে ঢাকার জরুরী কাজ সেরে আবার সন্ধ্যার মধ্যেই বরিশালে ফিরতে পারছেন। এ কারণে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি সড়ক পথে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় লেগেই রয়েছে। বরিশালের পরিবহন কাউন্টারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই ঈদের আমেজে এসব কাউন্টারে টিকেট বিক্রি হচ্ছে।

অপরদিকে যাত্রী সংকটে নৌ ও আকাশ পথে একের পর এক যান বন্ধ করে দেয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ দীর্ঘদিন এ দুটি রুটের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ ব্যক্তিকে পেশা পরিবর্তন করতে হতে যাচ্ছে। তাই দীর্ঘদিন সংসারের চাকা ঘোরানো ওইসব ব্যক্তির পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য আগলে রাখা পেশা হঠাৎ করেই ছাড়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবুও পদ্মা সেতুকে নিয়ে গর্ব করে পেশা পরিবর্তন করতে যাওয়া ব্যক্তিরা বলেন, বিশ্ববাসীকে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, আমরাও পারি। তারা আরও বলেন, এটা শুধু সেতু নয়; এই পদ্মা সেতু আমাদের মাথা উঁচু করতে শিখিয়েছে। আমাদের ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে-বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে একসময়ের ব্যস্ততম শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট। এখন আর কেউ এইপথে সচরাচর আসছেন না। সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লাখ লাখ মানুষের যাতায়াতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে। দূর হয়েছে যুগ-যুগের ভোগান্তি।

সূত্রমতে, নৌ-রুটকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিরা হচ্ছেন হকারি পেশার সঙ্গে জড়িত। যারা লঞ্চ ও ফেরিতে ঘুরে যাত্রীদের কাছে বিভিন্ন মুখরোচক খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী বিক্রি করেছেন। প্রতিটি লঞ্চে অসংখ্য হকার নানান জিনিসপত্র নিয়ে ওঠেন। এছাড়া ঘাটের পল্টুন ঘুরেও অনেক হকার নানারকম দ্রব্যাদি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অতীতে নৌ-রুটে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রীরাই ছিল তাদের ক্রেতা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রী সঙ্কটে নৌরুটের বিলাসবহুল লঞ্চগুলো যখন একপ্রকার বন্ধের উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তেমনি লঞ্চে আগের মতো যাত্রী না হওয়ায় হকারদের ব্যবসায়ও মন্দা ভাব দেখা দিয়েছে।

বরিশাল নৌ-টার্মিনালের একাধিক হকাররা বলেন, ব্যবসার মন্দাভাবের কারণে কিছুটা মন খারাপ হলেও পদ্মা সেতু চালু হয়েছে এটাই আমাদের কাছে আনন্দের বিষয়। বিকল্প পেশা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলছে। তবে আগের মতো এতটা ভাল হবে কিনা তা জানি না।

বরিশাল নৌ-বন্দর টার্মিনালে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে হকারি করেন আব্দুর রশিদ। এখানে হকারি করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে পুরো পরিবারের ভরণ পোষণ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর তার আনন্দের শেষ নেই। তবে লঞ্চে যাত্রী সঙ্কটে আগের মতো বিক্রি না হওয়ায় তার আয়ও কমে গেছে। তাই কপালে চিন্তার ভাঁজও রয়েছে। তিনি বলেন, হঠাৎ করেই পেশা বদল করা যায় না। দীর্ঘদিনের পেশা বন্ধ হয়ে গেলে পুরো পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে। তাই সরকারীভাবে হকারদের তালিকা করে সহজশর্তে ঋণ দেয়া হলে নতুন কিছু করতে পারব।

বরিশাল বিমান বন্দর সংলগ্ন এলাকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রায় প্রতিদিনই আকাশপথে কোন না কোন ভিআইপি ব্যক্তি বরিশালে আগমন করতেন। আর তাদের অভ্যর্থনা কিংবা বিদায় জানাতে হাজার-হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিমানবন্দর এলাকায় আগমন ঘটতো। ওইসময় তাদের বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী এক নিমিষেই বিক্রি হয়ে যেত। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রী সঙ্কটে ইতোমধ্যে একটি বেসরকারী এয়ারলাইন্সের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনেক ভিআইপি ব্যক্তিরা এখন পদ্মা সেতু হয়ে গন্তব্যে ফিরছেন। ফলে আগের মতো এখন আর হাজার-হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিমানবন্দর এলাকায় আগমন ঘটে না। তাই তাদের ব্যবসায়ও চরম মন্দা ভাব দেখা দিয়েছে।

তবুও গর্ব করে এসব ব্যবসায়ী বলেন, মাওয়া ঘাট এলাকার যুগ যুগ ধরে চলা ভোগান্তি থেকে দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে রক্ষা করেছে পদ্মা সেতু। বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়া এখন যেন হাতের মুঠোয়। তবে সড়কপথে যানজটমুক্ত নিরাপদে যাতায়াতের জন্য তারা জরুরীভাবে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়ককে এক্সপ্রেসওয়েসহ চারলেনে উন্নীতকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি করেছেন।

বন্ধ হয়ে গেছে জনপ্রিয় গ্রীন লাইন সার্ভিস ॥ ঢাকা থেকে নৌরুটে সকালে ছেড়ে দুপুরে বরিশালে যাত্রী নামিয়ে বরিশালের যাত্রীদের আবার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছে দিত এমভি গ্রীন লাইনের ক্যাটামেরন সার্ভিস। মাত্র এক হাজার ও সাতশ’ টাকায় দিনের বেলার এই যাত্রাটি বরিশালের মধ্যবিত্তদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ২০১৫ সলের ৮ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে ক্যাটামেরন সার্ভিসটি চালু করা হয়।

নৌপথের মতো আকাশপথেও মন্দা ॥ ঢাকা থেকে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য একটা সময় নৌপথের বিকল্প কোন কিছু ভাবাই হতো না। যাত্রীদেরও লঞ্চে ভিড় লেগেই থাকত। যাত্রীদের আরামদায়ক যাত্রার জন্য ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে একের পর এক যুক্ত হয়েছে বিলাসবহুল অসংখ্য লঞ্চ। এর মধ্যে অনেক লঞ্চে লিফট পর্যন্ত যুক্ত করা হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু চালু হবার পর থেকে নৌপথের সেই রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই। বর্তমানে পদ্মা সেতু দিয়ে সড়কপথে স্বল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে মানুষজন বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। এর প্রভাবে নৌপথের মতো আকাশপথেও চরম যাত্রী সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে যাত্রী সঙ্কটের কারণে ১ আগস্ট থেকে ঢাকা-বরিশাল আকাশপথে ফ্লাইট পরিচালনা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছেন বেসরকারী এয়ারলাইনস নভোএয়ার।

ভাড়া কমিয়েও যাত্রী মিলছে না লঞ্চ ও বিমানে ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই ঢাকা-বরিশাল রুটের আকাশ ও নৌপথে জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেছে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী। অতীতে আকাশ ও নৌপথে যাত্রীদের কাছ থেকে অধিক ভাড়া আদায় করা হলেও বর্তমানে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ভাড়া কমিয়েও যাত্রী সঙ্কটে ভুগছেন এই রুটের লঞ্চ ও এয়ারলাইনসগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পূর্বে ঢাকা-বরিশাল আকাশ পথে বেসরকারী ইউএস বাংলা ও নভোএয়ার সর্বনিম্ন ৪ হাজার ৭০০ টাকায় টিকেট বিক্রি করেছে। পদ্মা সেতু দিয়ে যানচলাচল উন্মুক্ত করার পর এ দুটি এয়ারলাইন্স গত ২০ জুলাই থেকে সর্বনিম্ন ভাড়া ৩ হাজার ৫০০ টাকা করছে। এতেও মিলছে না পর্যাপ্ত যাত্রী। সর্বশেষ নভোএয়ার যাত্রী সঙ্কটের কারণে ফ্লাইট বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। তবে ইউএস বাংলা তাদের নিয়মিত দুটি ফ্লাইট চালু রেখেছে। বিমান বাংলাদেশও তাদের একমুখী ভাড়া সর্বনিম্ন ৩৫শ’ থেকে এক লাফে কমিয়ে গত রবিবার থেকে তিন হাজার টাকা করেছে। এয়ারলাইন্সগুলোর বরিশালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে ভাড়া কমানো হলেও যাত্রী সঙ্কট কাটেনি।

অপরদিকে পদ্মা সেতু চালু হবার পর থেকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের নৌ-যোগাযোগে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চরম যাত্রী সঙ্কটের কারণে বিলাসবহুল লঞ্চগুলোর কর্মকর্তারা ভাড়া কমানোর ঘোষণা দিয়েও কাক্সিক্ষত যাত্রী পাচ্ছেন না।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com