শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ন

এ যুগের মানিকেরা!

রাজু আহমেদ, কলাম লেখক, একুশের কন্ঠ : সিলেটের এমসি কলেজের পরে এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রী’কে ধর্ষণ! সংবাদটি পড়তে পড়তে বারবার কেঁপে উঠেছি। বিবেক আত্মাহুতি দিতে চেয়েছে! এটা কি মানুষের সভ্যতা? জাবি’র সেই জসিমউদদীন মানিক ওরফে ‘সেঞ্চুরি মানিকে’র পর দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসটি নেতিবাচক সংবাদের বাইরে ছিল! ১৯৯৮ সালের কলঙ্কিত ঘটনার পর জাবি’র ক্যাম্পাসে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে যে মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল তা গতকালের খবরে পুরোপুরি ক্ষয়ে যাওয়ার বার্তা পেলাম! সেঞ্চুরি মানিকের উত্তরসূরীরা আবার কি সেই অন্ধকারের অনুসারী হয়েছে? বড্ড দুঃখ হয়, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্তদের দ্বারা যদি এই বর্বরোচিত নৃশংসতা, জঘন্যতম অসভ্যতামি হয় তবে অশিক্ষিত মানুষের অপরাধী মানসিকতাকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করবো। দু’টো অপরাধের সমান শাস্তি দেওয়ারও কি নৈতিক ভিত্তি থাকে?

তবুও আশায় বুক বাঁধি! নোয়াখালীর সুবর্ণচরের নির্বাচন পরবর্তী ক্ষোভে সংঘটিত সেই আলোচিত ধর্ষণকান্ডের রায় ঘোষিত হয়েছে। অভিযুক্ত ১০ জনের মৃত্যুদন্ড এবং ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। জাবিতে যে ঘৃণ্যতম অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে দোষীদের চূড়ান্ত পরিনতি দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনবো। অবাকও হবো না যদি ‘সেঞ্চুরি মানিকের’ মত অভিযুক্তরা বিদেশি পালিয়ে যায় কিংবা আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়! এখানে মাঝেমাঝে জুতা চোরদের যত কঠিন শাস্তি হয় ধর্ষণকারীর দায়মুক্তি তত সহজভাবেই হতে দেখেছি। কোথাও কোথাও তো উল্টো নারীকে দায়ী করা হয় আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দোররা! যে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রী’কে ধর্ষণ করা হয়েছে সে মানুষটি এখন জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজলে অবাক হবেন? যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে তার মানসিকভাবে মরণ তো ইতোমধ্যে হয়েই গেছে! অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে চলতে পারলে সবকিছুর চূড়ান্ত হবে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাতে জানলাম, জাবি’তে অ-ছাত্ররা দীর্ঘদিন হলের সিট দখল করে আছে। কেউ কেউ ক্ষমতার দাপটে একাই একরুম নিয়ে রেখেছে! সেখানে বিরোধীপক্ষের বিচার বসে, পানীয়ের আড্ডাও বসে! এর অধিক কিছুও ঘটতে পারে! তার অর্থ হচ্ছে, নতুন ও নিয়মিত শিক্ষার্থীরা হলে আবাসন পাচ্ছে না। যারা পাচ্ছে তাদেরকে গণরুমে থাকতে হচ্ছে! দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোতে এই যদি হয় সাম্যের হাল তবে বৈষম্যহীন সমাজের চিন্তা অলীক স্বপ্নের মায়াজালের অধিক কিছু নয়। শিক্ষিতজনের কাছে যদি নারী নিরাপদ না হয় তবে সুবর্ণচরের বর্বরদের শাস্তি নিয়ে ভাবতে হবে! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জাবি’র ঐ কুলাঙ্গারদের মানুষ করতে পারেনি! ছাত্রত্ব বাতিল এবং একবার ফাঁসির রশিতে ঝুলালেই ওদের পাপ মাফ হয়ে যাবে? দায় কার? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দীর্ঘদিন এই অ-ছাত্রদের ক্যাম্পাস ছাড়া করতে না পারা, রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচয় ব্যবহার করে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতা দেখানো-এসব শক্ত হাতে দমন করার হিম্মত রাষ্ট্রের হোক!

বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জ্ঞানের আঙনায় নারী নিরাপদ না হলে নারীর নিরাপত্তা বাইরে নিশ্চিত হবে-এমন নিশ্চয়তা কোথায় মিলবে? শিক্ষিত অপরাধীর বিচারের জন্য আইন এবং অশিক্ষিতদের জন্য আইন আলাদা হলে ভালো হয়! যে হাত দিয়ে নারীর স্বামীকে আটকে রেখেছে, যে হাত নারীর শরীরের সাথে জোরাজোরি করেছে ওই হাতওয়ালাদের কল্লায় রশি লাগানোর আগে হাত, চোখ এবং জিহ্বা যাওয়া দরকার। এইসকল অপরাধীদের ছাত্রত্ব বাতিল করা, বহিস্কার করা এবং সনদ না দেয়ার সিদ্ধান্ত তাদের অপরাধের তুলনায় শাস্তি ও শাসনের শিরোনাম মাত্র! শিক্ষাঙ্গনের মত পবিত্র স্থানে এমন ঘৃণ্য, বর্বরোচিত এবং নৃশংসতা যারা ঘটাতে পারে তাদের একবার শাস্তি হলে তা যথেষ্ট নয়! কঠোর শাস্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা না গেলে এই সমাজকে মানুষের জন্য নিরাপদ সমাজ বানানো যাবে না। নারী-পুরুষের বিশ্বাসের দূরত্ব ঘুচবে না। সব কুলাঙ্গারকে ওয়াজ-নসিহত করে সাধুবেশে ফেরানো যায় না। কখনো কখনো নতুন ছাঁচ দিতে হ্যামারও লাগে!

বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষেধ-এমন ঘোষণায় সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে কিন্তু এটি সম্পূর্ণভাবে সঠিক পদ্ধতি নয়। মানুষ তো পশু নয় যে বেড়া দিয়ে তার চরিত্র বদলানো যাবে! অ-ছাত্ররা বছরের পর বছর হলে অবস্থান করে নৈরাজ্য করবে-এটাও শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। ছাত্ররাজনীতির মদদ পেয়ে কোন অসাধুরা যাতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট না করে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নারীকে সম্মান করার ব্যাপারে যাদের পারিবারিক শিক্ষা নাই, যারা মানসিকতায় পশু ওদেরকে শোধরানোর জন্য পাথর থেরাপি অধিক কার্যকর! কিছু কিছু ঘৃণ্য অপরাধের শাস্তি প্রকাশ্যে দেওয়া গেলে তবে আমাদের স্ত্রী-কন্যারা অমানুষদের থেকে নিরাপদ থাকতো।

অবিলম্বেই জাবি’র ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে ঘরে-বাইরে পুরুষ হিসেবে নারীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবো। পুরুষ হিসেবে আপাতত লজ্জিত অবস্থায় আছি। স্ত্রীকে মুখ দেখাতেও লজ্জা লাগছে! গতকালের ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও জাগরণ আশান্বিত করেছে। সর্বত্রই খারাপের সংখ্যা নগন্য। ওদেরকে দমন করা না গেলে সেটা গোটা মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তদেরকে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে বয়কট করতে হবে। কুলাঙ্গারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে না পারলে এই সমাজ-সংসার, ধর্মশালা এবং শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত মানুষের জন্য নিরাপদ করা যাবে না। অথচ আমরা নিরাপদ নগরের স্বপ্ন দেখি! নারী-পুরষ একে অপরের প্রতি বিশ্বাস-ভরসা নিয়ে পাশাপাশি বাঁচতে চাই। অল্প কয়েকটি সে আশার আলো যাতে নিভিয়ে দিতে না পারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com