মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫, ০১:৪৯ অপরাহ্ন
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক:: মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২০২০ সালে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। করোনাকালীন সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় গত তিন মাসে (ডিসেম্বর-মার্চ) এটি এক লাফে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়ে গেছে। নানা সুবিধা দেওয়ার পরও ঋণ পরিশোধ না করায় মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে খেলাপি এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এ পরিমাণ গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণের স্থিতি বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২১ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। যা শতাংশ হিসেবে ১৯ দশমিক ৩০।
আর গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়বেই। যতদিন না সরকার ঋণ ফেরাতে আন্তরিক হবে ততদিন দেশে খেলাপি কমবে না। এ দেশে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংখ্যা বেশি। তাই বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার পরও কোনোভাবেই খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। এখন সেই সুবিধাগুলোও নেই। ব্যবসায়ীরা আবার সেই সুবিধা চেয়েছেন। এ সুবিধা দেওয়া কোনভাবেই উচিৎ হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
কেন বাড়ছে খেলাপি ঋণ- এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ঋণের কিস্তিতে সুবিধা (মরিটোরিয়াম) তুলে দেওয়ার পরে খোলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে গেছে। কারণ করোনার দুই বছরে খেলাপি খুব একটা দেখানো যায় নি। যদিও খেলাপি ছিল। আর সবচেয়ে বেশি খেলাপি হলো সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর। মুষ্টিমেয় কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি। বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ঋণ নেয় এসব ব্যাংক থেকে। কারণ ফেরত দেওয়ার চাপ কম এবং বিশেষ উপায়ে ম্যানেজ করার সুযোগ বেশি। তারা ঋণ ফেরত দেন না। আর ব্যাংকের পর্ষদ এসব ঋণ প্রদানে প্রশ্রয় দেয়। অথচ পর্ষদের কাজ হলো এ ধরনের ঋণ দিতে খবরদারি করা। ব্যাংকের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করা।’
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকগুলো পর্ষদের অনুমিত ছাড়া বড় বড় ঋণ দিচ্ছে ও খেলাপি হচ্ছে। যার মূলে রয়েছে ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ‘খেলাপিকে ব্যবসায়িক মডেলে রূপ দিচ্ছে’ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িরা। তারা ঋণ পরিশোধ না করে মামলার দিকে যাচ্ছেন। কালক্ষেপণ করছেন। ব্যাংকও ঋণ অবলোপন করছে। আর টাকা ভাগাভাগির নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো ফরেন একচেঞ্জ, আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা আপাতত খেলাপি ঋণ আদায়ের বিষয়ে ভাবছে না। দৃষ্টিটা অন্যদিকে চলে গেছে। এর ফলে খেলাপি ঋণের অংক বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত নজরদারি করা উচিত। তা না হলে অসুবিধায় পড়বে ব্যাংকিং খাত।’
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে দুই লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৮ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে দুই লাখ ৩৩ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৪৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে নয় লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে নয় লাখ ৭০ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৫১ হাজার ৫২০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১৫ কোটি টাকা, এই অংক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে মোট ৩৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অংক ছিল তিন হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা এই ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০২ শতাংশ।
বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ৬৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের দুই হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ছিল দুই হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঋণখেলাপির শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। মার্চ শেষে ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ১৩ হাজার ১২৪ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ খেলাপি হয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকের টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ন্যাশনাল ব্যাংকের। এই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা বা প্রায় ১৫ শতাংশ। বিদেশি খাতের সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। তাদের মোট ঋণের প্রায় ৯৯ শতাংশ বা ১৩৭০ কোটি টাকাই খেলাপি।
বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, দুই হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।