রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:২৪ পূর্বাহ্ন

এই মেলায় আসলে সবাই কাঁদে, তাই মেলাটিকে “কান্নাকাটির মেলা” বলে

লালমনিরহাট প্রতিনিধি:: লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের ঘোঙ্গাগাছ সীমান্তের নোম্যান্স্ ল্যান্ডে মালদহ নদীর তীরে গঙ্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিবছর চৈত্র মাসে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সীমান্তে উভয় মিলন মেলা হলেও স্থানীয়ভাবে এটি ‘কান্নাকাটির মেলা’ নামে পরিচিত। দু’দেশের মানুষ অনেক দিন পর একত্রিত হয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন বলে এই মেলাকে সবাই কান্নাকাটির মেলা বলেই জানে।

বুধবার (৩০ মার্চ) দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত গঙ্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিবছর চৈত্র মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সিতাই থানায় কাটাতারের বেড়ার পাশে ভেড়ভেড়ি এলাকায় মালদহ নদীর তীরে এ মেলার আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কঠোর নজরদারিতে সীমান্তের ৯১৫ নম্বর পিলারের কাছে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমল থেকে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে জানান স্থানীয়রা। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে গত ২ বছর মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, এটি সীমান্তে মিলন মেলা হলেও স্থানীয়ভাবে ‘কান্নাকাটির মেলা’ নামে পরিচিত। দুদেশের মানুষ অনেক দিন পর একত্রিত হয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন বলে এই মেলাকে সবাই কান্নাকাটির মেলা বলেই জানে।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ি ভাতিটারী গ্রামের প্রতাপ চন্দ্র রায় (৭৫) তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র রায়ের (৪৮) সঙ্গে কান্নাকাটির মেলায় এসেছিলেন তার মেয়ে নারায়ণী রানীর (৪৫) সঙ্গে দেখা করার জন্য।
নারায়ণী বিয়ে করে ভারতে বসবাস করছেন। ৪ বছর পর মেয়ের সঙ্গে দেখা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রতাপ চন্দ্র। তার মেয়ে নারায়ণীও কাঁদতে থাকেন। বাবা-মেয়ে একে অপরের গলা জড়াজড়ি করে বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেন। সেইসঙ্গে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও কাঁদতে শুরু করেন।

প্রতাপ চন্দ্র রায় জানান, তার শরীরের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় মারা যেতে পারেন। তাই মৃত্যুর আগে মেয়েকে দেখার জন্য এ মেলায় এসেছেন। মেয়েকে কিছু খাবার দিয়েছেন। মেয়েও তার জন্য খাবার এনেছিলেন।তিনি বলেন, তাদের পাসপোর্ট তৈরি করার সামর্থ্য নেই। তাই সীমান্তে কান্নাকাটির মেলায় এসে ভারতীয় আত্মী-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন।

প্রতাপের মেয়ে নারায়ণী রানী (৪৫) বলেন, প্রায় ২৮-২৯ বছর আগে ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সিতাই থানার গোবিন্দপাড়া গ্রামে বসবাস করছেন। ৪ বছর পর তিনি তার বাবাসহ বাংলাদেশি আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলেন।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার নয়ারহাট গ্রাম থেকে মেলায় এসেছিলেন রতন চন্দ্র রায় (৬৫)। দেখা করেন ভারতে বসবাস করা ছোট ভাই সুরেশ চন্দ্র রায়ের (৬০) সঙ্গে। প্রায় এক যুগ পর ২ ভাইয়ের দেখা হলে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। এ সময় দুই ভাই দুদেশে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন। ‘আমার যদি পাসপোর্ট করার সামর্থ্য থাকতো, তাহলে আমি পাসপোর্ট করে ভারতে যেতাম। ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়’, বলেন রতন চন্দ্র রায়।

ভারতীয় নাগরিক সুরেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমার অসংখ্য আপনজন বাংলাদেশে বসবাস করছেন। ভারতেও আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। আপনজনদের ছেড়ে কষ্টে বসবাস করছি। অনেক দিন পর দাদাসহ বাংলাদেশি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমি খুশি। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আগামি বছর আবারও সীমান্তের এই মেলায় আমরা মিলিত হবো।’

সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা জানান, উভয় দেশের নাগরিক মালদহ নদীতে পুণ্যস্নান করেন। বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিকরা কাঁটাতারের বেড়ার পাশে ভেড়ভেড়ি এলাকায় গঙ্গাপূজা করার পর মালদহ নদীতে পুণ্যস্নান করে থাকেন। করোনা মহামারির কারণে ২ বছর সীমান্ত মেলাটির আয়োজন করার ফলে এ বছর দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল।

গোড়ল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ‘সীমান্তে কান্নাকাটির মেলাটি আজ বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছিল। লালমনিরহাটসহ পাশের জেলা রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েক হাজার বাংলাদেশি এসেছিলেন কান্নাকাটির মেলায়। কেউ কেউ এসেছিলেন মেলা দেখার জন্য। অধিকাংশ মানুষ এসেছিলেন ভারতে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে মেলাটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, মেলা চলাকালীন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিকেল ৫টা পযর্ন্ত সীমান্তে মালদহ নদীর তীরে ভিড় ছিল মানুষজনের। মেলা শেষে দুদেশের নাগরিকরা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যান। এরপর বিকেল ৫টায় বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া বন্ধ করে দেয়।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com