বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫, ০২:২৪ পূর্বাহ্ন

আর বাস চালাবেন না মিমের বাবা

মোছাব্বের হোসেন,বিশেষ প্রতিবেদক:
মহাখালীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের পাশ দিয়ে একটা সরু গলি। গলি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে মহাখালী দক্ষিণ পাড়া এলাকা। এক পশলা বৃষ্টিতে কিছুটা পানি জমেছে সেখানে। দুই এক জায়গায় খোঁজ করা হলো বাসচাপায় নিহত হওয়া শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানমের বাড়ি কোথায়। এক দোকানদার বললেন মসজিদের পাশে দিয়ে বড় এক ভবনের পাশের বাম গলিতে। গলির মুখে মানুষের জটলা। দিয়ার বাড়ির কোথায় জানতে চাইলে সেলিম আহমেদ নামের একজন এগিয়ে আসে। কানা গলির শেষের বাসাটায় নিয়ে যেতে যেতে তিনি বলেন, ‘জানেন যে মেয়েটাকে কোলে থাকতে দেখে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম। কত বড় হয়ে গেছে। গতকাল শুনি সে আর নেই। কিছুতেই বিশ্বাস হইতেছে না।’

কথা বলতে বলতে দোতলা এক বাড়ির নিচ তলায় নিয়ে গেলেন সেলিম। ঘরের সামনে অনেক স্যান্ডেল, জুতা। এলাকার অনেকেই এসেছেন দিয়ার পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে। দুই কামরার বাড়িতে একটিতে জাহাঙ্গীর আরেকটি ঘরে তাঁর স্ত্রী মেয়ে আর ছেলে।

বাবা জাহাঙ্গীরের পাশে গোল হয়ে বসেছে সবাই। পরিচয় পেয়ে কথা বলা শুরু করলেন জাহাঙ্গীর। চোখে মুখে দীর্ঘ ক্লান্তির ছাপ। মেয়ে হারা এই বাবার চোখ কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে গেছে। চোখ ফুলে গেছে। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলা শুরু করলেন মেয়ের কথা। জাহাঙ্গীর বলছিলেন, মেয়ে আমার কলেজে গেলে ওর মায়ের কাছে খবর নেই, সে পৌঁছাইছে কি না। এবার বাড়ি আইলে জিগাই আসছে কি না। ওটা প্রতিদিনের রুটিন আমার। আমি ঢাকা-রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ রুটে একতা পরিবহনের বাস চালাই আজ ২৭ বছর ধইরা। কাইলকে দুইটার সময় আমি বাস নিয়া যাব চাপাই। যাওয়ার আগে ওর মারে কইলাম মে আইলে আমারে জানাইও। এই কথা কইয়া আমি বাইর হইছি কেবল। হঠাৎ এক ফোন আইল একটার দিকে। একজন কইল আপনার মেয়ে নাই জলদি আসেন। আমি কেমনে যাব কিসে যাব ভাবতে পারতাছিলাম না। পরে বাসে, রিকশায় বনানী পর্যন্ত গেছি। এক মোটরসাইকেল ওয়ালাকে কইলাম ভাই আমার মেয়ে অ্যাকসিডেন্ট করছে আমারে লইয়া যান। এরপর যা দেখলাম তা আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারমু না। গিয়া দেখি আমার মেয়ে আর নাই। জাহাঙ্গীরের চোখে আবার পানি জমে উঠেছে। টিস্যু দিয়ে সেই চোখ মোছেন তিনি।

জাহাঙ্গীরের ক্লান্ত শরীর মেয়ে হারানোর ব্যথায় যেন কুকরে আসছিল। তিনি বলা শুরু করলেন, মা আমার ভালো ছাত্রী ছিল। এসএসসিতে ভালো করছে। এ প্লাস পাইছে টিঅ্যান্ডটি মহিলা ডিগ্রি কলেজ থাইকা। পরে ওই কলেজে ওর ভর্তি হওয়ার খুব ইচ্ছা। এদিকে ভালো কলেজ নাই। অনেক দূর হয় তাও শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি কইরা দিলাম। মেয়েটা খুব খুশি আছিলো। প্রতিদিন কলেজে যায় আসে। আমি খবর নেই ও ঠিকমতো আইছে কি না। একবার গাড়ি নিয়ে আসা যাওয়া করলে ১ হাজার ২৫০ টাকা পাই। অনেক কষ্টের জীবন আমার। ভাড়া দেই. খাবার কিনি। মেয়েকে বুঝতে দেইনাই কষ্টে আছি। শুধু চাইছি মেয়েটা বড় হউক। ওরে নিয়ে কত স্বপ্ন আমার….। জাহাঙ্গীর থেমে যান। অভিমান করে বলেন, এত দিন বাস চালাই কই ফেডারেশনের কেউতো আইল না। মেয়ে মরা বাপ আমি কি কষ্টে আছি কেউ তো খবর নিল না। আমাগো অভিভাবক মন্ত্রী শাহজাহান খান তিনি নাকি আমার মেয়েসহ দুজন মরার কথা বলতে বলতে হাসতে ছিলেন। এই কথা শুইনা আমার দুঃখে বুক ভাইঙ্গা আসছে…। আমি আর বাস চালামু না। যেই বাস আমার মেয়েরে নিয়া গেল। সেই বাস আর ধরুম না আমি। আমি সারা জীবন বাস চালাইছি সেই ছোট থাইকা কেউ আমার গাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয় নাই। আমি তো কাউরে মারি নাই। তাইলে আমার মতো মানুষের মেয়ের কপাল এমন হইলো কেন?

ঢাকায় যারা বাস চালায় তাদের ঠিকমতো গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেই বলে মনে করেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, খোঁজ নেন এরা হেলপার। দুই দিন বাস চালাইয়া ড্রাইভার হইয়া গেছে। তো এরা মানুষ মারব না তো কি? এদের কোনো ঠিকানা নাই। আপনারা আসল জায়গায় হাত দেন। এই যে নিরাপদ সড়ক চান কি লাভ, আমার মেয়েরে তো ফেরত পামুনা। আপনারা উদ্যোগ নেন। আমি বাস চালানো শিখামু। প্রশিক্ষণ ছাড়া একজনেরও লাইসেন্স দিবেন না। আমি বিআরটিএকে সহায়তা করমু।
মেয়ের কথা বলতে গিয়ে আবার আবেগাপ্লুত হয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই। এটাতো দুর্ঘটনা না। পুলিশ আমাকে বলছে মামলা করতে। আমি তো মেয়েরে নিয়া ব্যস্ত। মেয়েরে পোস্টমর্টেম করি নাই। অমনি মাটি দিছি। কি মামলা হইছে জানি না। এখন শুনি দুর্ঘটনা। এটা কেমন দুর্ঘটনা। এটা তো হত্যা, নাকি? আমি কেন সবাই বলব এটা হত্যা।

জাহাঙ্গীরের পাশের ঘরে দিয়ার মা রোকসানা বেগম জায়নামাজে বসে কাঁদছিলেন আর মেয়ের নাম ধরে বিলাপ করছিলেন। তিনি বলছিলেন, কিছুই চাই না আমি। মেয়ে হত্যার বিচার চাই। প্রতিদিন মেয়েকে গাড়িতে উঠাই দিয়া আমি আইসা পড়ি। এই মহল্লার অনেকে ওই কলেজে পড়ে। ওগো লগে মেয়ে আমার আইসা পড়ে। মেয়ে আমার কাছে কিছুই চাইতো না। ওর কোনো চাহিদা নাই। যা দেই তাই খায়। শুধু চাইছে যে মা আমি ওই কলেজে পড়মু আমার খুব ইচ্ছা। মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করলাম। সেই লক্ষ্মী মেয়ে আমার এভাবে মারা গেল। মা আমার নাচ-গান এগুলো খুব পছন্দ করত। আমিও বাধা দিতাম না। আমার বড় মেয়ে রিয়ার লগে ওর কি ভালো ভাব। দুজনে আমার সংসারের সুখ। এক ছেলে ছোট। কষ্টের সংসারে ওরাই আমার মন ভইরা রাখতো। এখন আমার মা নাই। আমাদের ছেড়ে চলে গেল…।

রোকসানা বেগম বলছিলেন, ঠিক এক মাস আগে ও কলেজে ভর্তি হয়ছিল। এক মাস পড়েই চলে গেল আমাদের ছেড়ে। মা আমার এই অল্প সময়ে সবাইরে আপন করে লইছিলো। সব কথা আমারে কইতো। কলেজে কী কী হইতো সব কইতো। ওর কয়েকটা বই কম ছিল। তাও কালকে কিনা রাখছি। যাতে আমার মায়েরে স্যাররা কলেজে দাঁড় না করায়। এভাবে চলে যাইবো তাই মায়া বাড়ছিল মা আমার। রোকসানা বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না। মাথা ঠুকতে থাকলেন। পাশ থেকে দিয়ার বড় বোন রিয়া বলতে শুরু করলো আমি আর দিয়া খুব মিল আমাদের। গল্পের বই পড়তে ভালো বাসতো। কার গল্প সেইটা দেখতো না। কোনো গল্প ভালো হলেই ও পড়ত। গণিতে ভালো ছিল দিয়া। এখন আর কাকে আমি আপু বলে ডাকমু?
রোববার দুপুরের দিকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়।

নিহত দুই শিক্ষার্থী হলো শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম ওরফে রাজীব (১৭) ও একই কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম ওরফে মিম (১৬)।

বাসচাপায় প্রাণহানির ঘটনায় গতকাল রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করছেন নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানমের (মিম) বাবা জাহাঙ্গীর আলম। সুত্র-প্রথম আলো

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com