রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৯:১৯ অপরাহ্ন

আমরা সর্বত্রই ঋণী!

রাজু আহমেদ।।
টাকা ধার করেছেন-সেটাই শুধু ঋণ? এটা ক্ষুদ্রার্থে, বৃহদার্থে আরও বড় কিছু! বেঁচে থাকতে, সুখে থাকতে চারপাশের মানুষ এবং বসুন্ধরা থেকে যা যা পাচ্ছেন তার সবটুকুতেই ঋণ! মা দুধ খাওয়াচ্ছে, বাবা লালন-পালন করছে, শিক্ষক জ্ঞান দিচ্ছে-এইসব ঋণ অস্বীকার করতে পারেন? যে প্রভূ না চাইতেই আপনাকে জীবন দিয়েছে, অক্সিজেন ফ্রিতে বিলোচ্ছে সেই প্রভূর কাছে ঋণ না থাকলে সমস্ত দিন রোজা থাকেন কেন? শীতের রাত জেগে ইবাদত করার মানসিকতা ঋণের মনোভাব থেকেই তৈরি হয়!

যে মানুষটি তার দু’মিনিট আমার জন্য ব্যয় করেছে আমি তার কাছে ঋণী না? যে মানুষটি তার প্রিয় পরিবার ছেড়ে আপনার কাছে থাকছে, আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে কিংবা আপনার সুখে আনন্দিত হচ্ছে তার ঋণ অস্বীকার করা যায়? যে চাষা কাঁদা-পানিতে একাকার হয়ে চাষাবাদ করে ফল-ফলান্তি করছে তার ঋণ দূরতম ভাবতে পারেন কিন্তু ওই কাজ বন্ধ করলে জীবের অস্তিত্ববিলীন হয়ে যাবে। যে শ্রমিক পোশাক সেলাই করছে, যে মজুর অক্লান্ত খেঁটে যাচ্ছে তাদের পারিশ্রমিক পয়সায় শোধ করতে পরবেন কিন্তু ঋণ শোধ করার সাধ্য আদৌ কারো নাই, থাকে না।

অর্থ দিয়ে ঋণ শোধ হয় না। মায়ের দুধের দাম ক’আনায় দিবেন? বাবার ঘামের মূল্য কত টাকায় শোধ করবেন? এই যে প্রকৃতি আপনার বাঁচার রসদ দিচ্ছে, আপনার ভাষিক ক্ষমতা, দৃষ্টির প্রসারতা, নাক-কান-গলার শুভ্রতা ক’পয়সায় রবকে ফিরিয়ে দেবেন? আমরা আসলে কারো ঋণ শোধ করতে পারি না। যে আমাকে একটি সৎ উপদেশ দিয়েছে, যে আমাকে সঠিক পথে দিশা দিয়েছে এবং যিনি আদর-স্নেহে ভালোবেসেছে তাদের কারো ঋণ মানব জনমে শোধ হয় না যদি কৃতজ্ঞতা বোধের উপস্থিতি না থাকে!

হাজারো মানুষের মধ্যে যে মানুষটি বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছে, আমার জন্য কিছু না করলেও পারতো অথচ দায়িত্ব নিয়ে করেছে, বুঝিয়েছে এবং শুনিয়েছে শান্তির বাণী তার ঋণ অস্বীকার করলে ধরণী কেঁপে উঠবে না? অশান্তির মাঝেও যিনি শান্তিকামী ছিলেন, অবিশ্বাসের মাঝেও যিনি ভরসা হয়েছিলেন, বিপন্নতার দিনেও যিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তার কাছে ঋণ আছে। মানবপ্রকৃতিতে আমরা অকৃতজ্ঞ হতে পারি, দলিয়ে-মাড়িয়ে যেতে পারি আকাশ তবে সত্যের দায় থাকে। শোধ না করলে সে পাওনা কেড়ে নেয়!

কৃতজ্ঞতাবোধ মানুষকে বিনীত হতে শেখায়। সহজ-সরল জীবনযাপনে সহায়তা করে। সবাইকে অস্বীকার করেও টিকে থাকা যায় কিন্তু ভালো থাকা যায় না। যে মনে অহংকার-দাম্ভিকতা বাসা বাঁধে এবং যে কাঁধে অন্যের অধিকার ভর করে না তাদের মধ্যে ঔদ্ধত্য নেমে আসে। হাওলাতের ঋণের চেয়েও আরও যেসব ঋণে আমরা জড়িয়ে আছি তার কোনটিকেই যেন অস্বীকার না করি! ভুলেও যেন না বলি, আমি একাই স্বয়ংসম্পূর্ণ! এ গুণ প্রভূত্বের! যারা ক্ষুদ্র, যারা নশ্বর তারা কোথাও না কোথাও ঠেকে আছি! ঋণগ্রস্তের গর্ব-দেমাগ থাকা মানায় না। সে কোমল হৃদয়ের হবে, স্বভাবে ব্যাকুলতা ধরে রাখবে। পরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবে। একা হয়ে কী লাভ?

আমরা আসলে সর্বত্রই ঋণী! এই যে ধনী কিংবা ধনীর ছদ্মবরণ তাও ঋণ করে। আমার পরিপাট্যে, আমার অর্থ-বিত্তে কারো না কারো দয়ার ছাপ আছে। কারো না কারো দয়ার দাগ আছে। আমরা অস্বীকার করতে পারি কিন্তু ঋণ আমাদের ছেড়ে যায় না। ঋণ অনাদায়ী থাকলেও ঋণ মাফ হয় না। সে অল্প অল্প করে বাড়তেই থাকে! বিনিময় দিয়ে সব দায় মিটিয়ে দেওয়া যায় না। অবনত থাকতে হয়। বিনীতের সম্মান বাড়ে এবং ধীরে ধীরে ঋণ কমে! বিদায়ের আগে যতবেশি ঋণ চুকিয়ে যাওয়া যাবে ওপারে ততবেশি সম্মান বাড়বে। ধ্যান-জ্ঞানে ঋণ কমানোর তপস্যা থাকুক। সবার জন্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাড়ুক। সেদিন সুখের হবে।

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Titans It Solution