শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:০১ অপরাহ্ন
অর্থনৈতিক ডেস্ক:: দেশের ব্যাংকিং খাতের উদ্যোক্তারা এখন পুঁজি ছাড়াই ব্যবসা করছেন। কোনও কোনও উদ্যোক্তা এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আরেক ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। কেউ কেউ বিনিয়োগ করা টাকার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি অর্থ ঋণ নিয়েছেন। অর্থাৎ যাদের ব্যাংকের মালিক বলা হচ্ছে, পুরো ব্যাংকিং খাতে তাদের একটি টাকাও নেই। বরং পরিচালক পরিচয়ে তারা আমানতকারীদের জমানো টাকার ভেতর থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে পরিচালকদের বিনিয়োগ মাত্র ৪৬ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। একই সময়ে পরিচালকরা ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে তুলে নিয়েছেন এক লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকারও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানতকারীদের ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৮১৪ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘোষণা দিয়ে নেওয়া ঋণের বাইরে পরিচালকরা আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব বা অন্য কারও নামে আরও প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর পরিচালকের সংখ্যা এখন প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন শতাধিক পরিচালক। তারা একজন আরেকজনের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ১১ হাজার ৯১০ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ৯ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। এছাড়া, পরিচালকরা জনতা ব্যাংক থেকে ৮ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া থেকে ৫ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ও ঢাকা ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর বাইরে আরও ৫০টি ব্যাংক থেকে পরিচালকরা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিচালকরা বেপরোয়াভাবে ঋণ নেওয়ার কারণে আমানতকারীরেই ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে যে খারাপ সংস্কৃতি চলছে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন পরিচালকরাই।’ তিনি বলেন, ‘পরিচালকদের অনেকেই এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আরেক ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, একজন ছয় থেকে সাতটি ব্যাংকের মালিক। এতে নিশ্চিত করে বলা যায়, ওই ব্যক্তি এক ব্যাংকের ঋণ নিয়ে আরেক ব্যাংকের মালিক হয়েছেন।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পরিচালকরা যখন মিলে-মিশে ব্যাংকের সব ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন বিভিন্ন খাতের ভালো শিল্প উদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পান না। আবার ঋণ পেলেও সুদের হার অনেক বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিশেষ করে যারা সত্যিকার অর্থে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে চান, তারাই বেশি বিপাকে পড়েন। এছাড়া পরিচালকদের অনিয়মের খেসারতও দিতে হয় ভালো উদ্যোক্তাদেরই।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে সাত লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন এক লাখ ৪৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। আর ব্যাংকটির ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েরি মনিটরিং শাখার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত পরিচালকদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৬ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। এই অর্থ ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডার বা মালিকদের জোগান দেওয়া মূলধন হিসেবে বিবেচিত। তবে আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়।
এদিকে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংকগুলোর অন্যান্য সম্পদসহ মোট রেগুলেটরি ক্যাপিটালের পমিাণ দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ১০১ কোটি টাকা। এটা ব্যাংক খাতের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের যা ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘পরিচালকরা যদি বিনিয়োগের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ তুলে নেন, তাহলে এটা হবে ব্যাংকিং খাতের নতুন ঝুঁকি। কারণ, ব্যাংকে যখন পরিচালকের নিজের কোনও বিনিয়োগ থাকবে না, তখন ব্যাংকের প্রতি তার দরদও কম থাকবে। এতে ব্যাংকটি যেকোনও সময় বিপদে পড়তে পারে।’ এ জন্য তিনি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে দক্ষ ও যোগ্য লোক থাকা জরুরি বলেও মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত রাখা অ্যাকাউন্টধারী রয়েছেন ১০ কোটিরও বেশি। এই অ্যাকাউন্টধারী ১০ কোটি মানুষের আমানত নিয়েই মূলত ব্যাংক ব্যবসা করছেন পরিচালকরা। যদিও অধিকাংশ সময় আমানতকারীদের সুদ বা মুনাফা কম দিয়ে পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ দেখা হয়। শেয়ারহোল্ডারদের কোনও কোনও ব্যাংক ২৫ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিলেও আমানতকারীদের সুদ দেয় ৫ শতাংশেরও কম।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘পরিচালকরা কেবল ব্যাংক ব্যবসা করছেন না, তারা পুরো ব্যাংক খাতকে নিয়ন্ত্রণও করছেন।’ তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, পরিচালকদের পছন্দের লোক ছাড়া ঋণই দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি নিয়েও প্রশ্ন আছে।’
অধ্যাপক সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে, যেগুলো ব্যাংক খাতকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর সঙ্গে পরিচালকরা যদি নিজেদের বিনিয়োগের চেয়ে বেশি টাকা তুলে নেন, তাহলে ব্যাংক খাতে শঙ্কা বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো ব্যাংক খাত। অথচ ব্যাংকগুলোতে দক্ষ লোকের পরিবর্তে এখন পরিচালক নিয়োগ হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে নিয়োগ পেয়েই পরিচালকরা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেওয়া শুরু করেন। এতে ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের অনাস্থা বাড়ছে।’