বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫১ অপরাহ্ন
মালয়েশিয়ায় কর্মরত নির্মাণ শ্রমিক অনলাইন ডেস্ক:: বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে গত বছরের ৩১ মে’র পর থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়া বন্ধ রয়েছে। এরপর পুনরায় শ্রমবাজার চালুর বিষয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিকবার আলোচনা হয়। যেতে না পারা কিছু কর্মীর বিষয়ে মালয়েশিয়া সিদ্ধান্ত জানালেও নতুন করে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে তেমন কোনও অগ্রগতি নেই। তবে বিদ্যামান সমঝোতার আওতায় সম্প্রতি কর্মী নিতে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যার বিষয়ে নতুন করে ভাবছে দেশটি। তাই বাংলাদেশকে তথ্য চেয়ে মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) চিঠি দিয়েছে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, মিয়ানমার থেকে কর্মী নিতে শর্তসহ এসব দেশের দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে মালয়েশিয়ার সরকার। চিঠিতে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করে, মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ ও কাজে নিয়োগের সুবিধার্থে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা যৌক্তিক করতে সম্মত হয়েছে। এই যৌক্তিকতা ১০টি বাধ্যতামূলক মানদণ্ড অনুসারে মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত সুনির্দিষ্ট এবং যোগ্যতা-ভিত্তিক যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শর্ত অনুযায়ী আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তালিকা সে দেশের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে। মালয়েশিয়া সরকার বলছে, তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এজেন্সির নাম দিতে হবে। শর্ত পূরণ না করলে কর্মী নিয়োগের জন্য তাদের বিবেচনা করা হবে না। আরও বলা হয়েছে— এই নীতি দুই দেশের মধ্যে গঠনমূলক এবং নৈতিক শ্রম অভিবাসন অনুশীলনকে শক্তিশালী করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
মালয়েশিয়া সরকারের দেওয়া শর্তের মধ্যে আছে- ন্যূনতম পাঁচ বছর ধরে কর্মী পাঠিয়েছে এমন এজেন্সি, গত পাঁচ বছরে অন্তত ৩ হাজার কর্মী পাঠিয়েছে, অন্তত তিনটি দেশে গত পাঁচ বছরে কর্মী পাঠিয়েছে, উৎস দেশে কর্মী পাঠাতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের লাইসেন্স আছে, গন্তব্য দেশের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভালো কাজের স্বীকৃতি আছে, জোরপূর্বক শ্রম, মানবপাচার, শ্রম আইন লঙ্ঘন, জোরপূবক অর্থ আদায়, মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য আর্থিক অপরাধে সংশ্লিষ্ট নয়, সব ধরনের সুবিধাসহ নিজস্ব প্রশিক্ষণ সুবিধা আছে, পাঁচটি আন্তর্জাতিক নিয়োগকর্তার কাছ থেকে প্রশংসাপত্র, অন্তত ১০ হাজার স্কয়ার ফিটের নিজস্ব অফিস আছে এবং মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে বৈধভাবে এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রমাণপত্র থাকতে হবে।
মালয়েশিয়ার এমন শর্তে হতবাক হয়েছে বেশ কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি। তাদের মতে, অনেকেই এসব শর্ত পূরণ করার সামর্থ্য রাখে না। তাই এটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের আলোচনা করা উচিত।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি রিক্রুটিং এজেন্সির স্বত্বাধিকারী বলেন, মালয়েশিয়া চিঠি দিয়েছে আমরা শুনেছি। কিন্তু আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে এখনও কিছু জানানো হয়নি। আমরা আন-অফিশিয়ালি কাগজগুলো দেখেছি। সেখানে ১০টি শর্ত আছে রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য। শর্তের অনেকগুলো যেমন- ১০ হাজার স্কয়ারফুটের অফিস অনেকেরই নেই। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়েছে এরকম অনেকের নামে মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য মামলা আছে। তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করতে হবে। আমার মতে, মন্ত্রণালয়ের উচিত এই বিষয়ে এজেন্সির মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করা। আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া। আবার মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অতীতের রেকর্ড থাকতে হবে। সব মিলিয়ে শর্তগুলো বেশ কঠিন মনে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির আলোকেই তো কর্মী পাঠাতে হবে। সেখানে উল্লেখ আছে মালয়েশিয়া সরকার নির্ধারণ করবে কারা কর্মী পাঠাবে।
এই বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, চিঠির বিষয়ে এখনও কিছু জানানো হয়নি।
২০০৮ সালে বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, আট বছর পর তা চালু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে ফের ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খুলতে সময় লেগেছিল তিন বছর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী সর্বশেষ কর্মী গেছে গত বছরের ৩১ মে। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও শেষ মুহূর্তে প্রায় ১৭ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। তাদের মধ্যে থেকে ৭ হাজার ৮২৩ জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করে মালয়েশিয়ার সরকার। ইতোমধ্যে তাদেরকে সেদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে নতুন কর্মী নিয়োগ এখনো বন্ধ আছে।
বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট গড়ে দুর্নীতি করেছে, এমন অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর দুই দেশের মধ্যে অনেক আলোচনার পর ২০২২ সালের আগস্টে আবার শ্রমবাজার খুলে দেওয়া হয়। সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত রাখার আন্দোলন করা হলেও শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার শর্ত অনুযায়ী প্রথমে ২৫টি এজেন্সি দায়িত্ব পেলেও পরে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা বাড়িয়ে ১০১টি করা হয়।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়ে গত মে মাসে সেদেশে সফর করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সেখানে মালয়েশিয়া সরকারকে সব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সে সময় আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘‘আমরা অনুরোধ করেছিলাম— বাংলাদেশে যারা রিক্রুটিং এজেন্ট আছে, তারা সবাই যেন লোক পাঠানোর সুযোগ পায়, এটা আমরা অনেক ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছি। তারা বলেছেন, এটি ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখবেন। আমাদের অচিরেই তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।’’
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে সোচ্চার থাকা ব্রিটিশ অধিকার কর্মী এন্ডি হল এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ‘‘যদি এই মানদণ্ডগুলো নিরপেক্ষভাবে এবং ন্যায্যভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে আমি কেবল কয়েকটি বিদ্যমান লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্সির কথা বলতে পারি, যারা মেনে চলতে পারে এবং এমনকি তাদের মধ্যে কিছু সম্ভবত সব মানদণ্ড মেনে চলতে পারবে না। আমার ধারণা, এটি মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের একতরফা ‘যৌক্তিকতা’ বা ন্যায্যতা অনুশীলন নয়, বরং সেই শক্তিগুলোর আরেকটি পরোক্ষ প্রচেষ্টা, যা মালয়েশিয়ায় ‘সিন্ডিকেশনে’ দেশটিতে নিয়োগকে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।’’
তার মতে, অনেকে আশঙ্কা করছেন, এটি মালয়েশিয়ার জন্য একটি পদ্ধতিগতভাবে সিন্ডিকেটেড নিয়োগ প্রক্রিয়ার সূচনা, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত, অবৈধ এবং অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। মানদণ্ড (৫) এবং (৬) বিশেষত আকর্ষণীয় মানদণ্ড, কারণ এটি বর্তমানে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক সরবরাহকারী অভিবাসীদের যেকোনও উৎস দেশের পক্ষে ন্যায্য বা নৈতিক বা ভালোর এই মানদণ্ডটি নিরপেক্ষভাবে বা ন্যায্যভাবে বিচার বা প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি লড়াই হবে। সুতরাং, মূলত এটি দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে একটি ‘ভালো আচরণ’ এবং ‘নৈতিক’ প্রশংসাপত্র পেতে সহায়তা করতে পারে।