রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৯ পূর্বাহ্ন

পাঁচ কিলোমিটারে পাঁচ বাঁধ আড়িয়ালখাঁ এখন বদ্ধ জলাশয়

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিঃ কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদরের থানার সামনে থেকে আড়িয়ালখাঁ নদকে দুই ভাগ করে একটি বাঁধ দেওয়া হয় আশির দশকে। এই বাঁধের প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে আরেকটি বাঁধ দেওয়া হয় প্রায় এক যুগ আগে। এরপর আশপাশে আরো তিনটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। সব মিলিয়ে এখানে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি বাঁধ নির্মিত হয়েছে।

বেআইনিভাবে নির্মিত এসব বাঁধের কারণে একসময়ের খরস্রোতা আড়িয়ালখাঁ এখন বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা না করে উন্নয়নের নামে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এখন অবশ্য সর্বশেষ নির্মিত বাঁধটি আংশিক অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

বাঁধগুলো হলো কটিয়াদী উপজেলা সদরের থানার সামনে থেকে জালালপুর ইউনিয়নের ঝাকালিয়া পর্যন্ত বাঁধ, বীর নোয়াকান্দি-খামখেয়ালির বাজার (চরনোয়াকান্দি) বাঁধ, বরাদিয়া-ফেকামারা বাঁধ, চরিয়াকোণা-ফেকামারা বাঁধ এবং লোহাজুরী-নাথের বাজার বাঁধ। প্রথম চারটি বাঁধ কটিয়াদী সদরের সঙ্গে জালালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকাকে যুক্ত করেছে। শেষের বাঁধটি যুক্ত করেছে লোহাজুরী ইউনিয়নের দুটি এলাকাকে।

কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে এসব বাঁধ দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘নদীতে বাঁধ দেওয়া বেআইনি। বাঁধ দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাউবোর মতামত নেননি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। এরপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

স্থানীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আড়িয়ালখাঁর বুকে প্রথম বাঁধ নির্মাণ করা হয় আশির দশকে। কটিয়াদী থানার সামনে থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধ

ঝাকালিয়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এই বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা সড়কও নির্মিত হয়েছে। এটা ব্যস্ত সড়কে পরিণত হয়েছে। সড়কের দুই পাশে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে। এই বাঁধের প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে বীর নোয়াকান্দি-খামখেয়ালির বাজার বাঁধটি ১০ থেকে ১২ বছর আগে। এটির ওপর ইট বিছিয়ে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এটাও এখন ব্যস্ত সড়ক। এরপর একে একে অন্য বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়। সর্বশেষ বরাদিয়া-ফেকামারা বাঁধটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। এই বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় রাজনীতিক সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘সরকার যেখানে নদী রক্ষায় কাজ করছে। সেখানে আমাদের এখানে নদী হত্যা করে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে, রাস্তা করা হচ্ছে। সেতু করে দিলে তো অন্তত নদীটি বেঁচে যায়। জীববৈচিত্র্য ঠিক থাকে। পরিবেশ ভালো থাকে। ’ তিনি অভিযোগ করেন, সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এই বাঁধগুলো নির্মাণ করেছেন।

খামখেয়ালি বাজারে কথা হয় উত্তর চরপুখিয়া গ্রামের আব্দুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাময়িক সুবিধার জন্য বাঁধ দিয়ে নদী মেরে ফেলা হয়েছে। কটিয়াদী থানার সামনে নদের ওপর নির্মিত সড়কের ওপর চায়ের দোকানে চা পান করছিলেন

শিক্ষক জয়নাল আবেদীন। বাঁধ দিয়ে একসময়ের খরস্রোতা নদটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত করায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আড়িয়ালখাঁয় পানিপ্রবাহ ফেরাতে হবে। এতে যদি এই সড়ক ও দোকানপাট সরাতে হয়, তাহলে তা-ই করা উচিত।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁধগুলোর কারণে নদটির এখন কোথাও সামান্য জলাধার, কোথাও কিছু জলাবদ্ধতা, কচুরিপানার জঞ্জালের চিহ্ন নিয়ে টিকে রয়েছে। স্থানীয় লোকজন ও পাউবো সূত্রে জানা যায়, আড়িয়ালখাঁর উৎপত্তি কিশোরগঞ্জের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। সেখান থেকে একটি শাখা হয়ে কটিয়াদী সদরে মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুলিয়ারচর পর্যন্ত গেছে। এই অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার। একসময় ময়মনসিংহ, ভৈরব, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আড়িয়াল খাঁ দিয়ে নৌপথে যোগাযোগ ও মালপত্র পরিবহন হতো।

সর্বশেষ নির্মিত বাঁধের বিষয়ে কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাকুর রহমান বলেন, তিনি কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা) চার লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণ করে জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছেন।

তবে জেলা প্রশাসকের নির্দেশের পর গত মঙ্গলবার থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান নিজ দায়িত্বে বরাদিয়া-ফেকামারা বাঁধটি অপসারণ শুরু করেছেন। বাঁধটির একাংশ অপসারণ করে এরই মধ্যে পানি চলাচলের জন্য পথ করে দেওয়া হয়েছে। অপসারণের বিষয়টি নিশ্চিত করে চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান বলেন, বাঁধ বা সড়ক যদি ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে এটি রাখা হবে না।

কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতিশ্বর পাল বলেন, সর্বশেষ নির্মিত বাঁধটি জেলা প্রশাসনের নির্দেশে অপসারণ করা হচ্ছে। আপাতত পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরনো বাঁধগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ওগুলোর ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওগুলো অপসারণে বড় প্রকল্পের প্রয়োজন হবে।

এর আগে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলমের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরা যোগাযোগ করার পর তিনি খোঁজখবর নিয়ে সর্বশেষ করা বাঁধটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘নদীতে বাঁধ দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে এগুলো উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ’

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com