মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫২ অপরাহ্ন

জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি কূটনীতিকদের আগ্রহ তুঙ্গে

নিজস্ব প্রতিবেদক, একুশের কণ্ঠ:: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি কূটনীতিকদের আগ্রহ এখন তুঙ্গে। ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত ভোটকে সামনে রেখে ঢাকায় কর্মরত রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও বিশেষ দূতেরা নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তাদের প্রত্যাশা- নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক। সাম্প্রতিক সময়ের সফর ও বৈঠকগুলোতেও সেই বার্তাই উঠে আসছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ার পেছনে যেমন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট রয়েছে, তেমনি রয়েছে বৈশ্বিক কৌশলগত স্বার্থও।

অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ নানা দেশের প্রতিনিধিরা আসন্ন নির্বাচনের পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিদেশি শক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী। কারণ এই অঞ্চল এখন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিদেশি বিনিয়োগ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দিকেও তাদের নজর রয়েছে। বিশেষত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ২০২৬ সালের নির্বাচনের ঘোষণার পর থেকে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহ আরও বেড়েছে।

অস্ট্রেলিয়া ও জার্মান মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক ঢাকা সফর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক, কানাডা ও চীনের কূটনীতিকদের বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ- সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের মতো এবারও বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকা।

চলতি অক্টোবর মাসে ঢাকায় কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রী অ্যান অ্যালি সফর করেন ঢাকা। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার সম্পৃক্ততা বাড়ানো ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করাই ছিল তাঁর সফরের মূল উদ্দেশ্য। তিনি উদ্বোধন করেন ‘অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ প্ল্যান ২০২৫-২০৩০’। সফর শেষে তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের যাত্রায় পাশে থাকবে।

একই সময়ে জার্মানি থেকেও আসছেন উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নবিষয়ক উপমন্ত্রী জোহান সাথফের দুদিনের সফর ছাড়াও জার্মান সংসদ সদস্য বরিস মিজাতোভিচ এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের একটি দল অক্টোবরজুড়ে ঢাকায় ছিলেন। তাঁরা বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

২৩ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লটজ বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন শুধু দেশের জন্য নয়, আঞ্চলিক গণতন্ত্রের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটনও ঢাকা সফর করেন। যদিও তাঁর সফর ছিল বাণিজ্যকেন্দ্রিক, তবে আলোচনায় উঠে আসে আসন্ন নির্বাচন। তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই সফরগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা তাদের স্বার্থের সঙ্গেও সরাসরি সম্পর্কিত।

একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সক্রিয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপকমিটির প্রতিনিধি দল আগস্টে ঢাকায় এসে নির্বাচনকে বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেন, ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধভাবে এগোচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রও একই বার্তা দিচ্ছে। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত সার্জিও গোরের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নিউইয়র্কে বৈঠকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনও নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, এটি তাদের নিয়মিত কূটনৈতিক সম্পৃক্ততারই অংশ।

কানাডার হাইকমিশনার অজিত সিং এবং চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। চীন বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যেখানে আসন্ন নির্বাচনও আলোচ্য বিষয় ছিল।

কূটনৈতিক সূত্রের ভাষায়, যত দ্রুত বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, ততই মঙ্গল। নির্বাচিত সরকার থাকলে বিনিয়োগের পরিবেশ স্থিতিশীল হয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে বিদেশিরা তৎপর থাকে। কারণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সব সময় হয় না। বাংলাদেশে কয়েকটি ভালো নির্বাচন হয়েছে, কয়েকটি মন্দ নির্বাচন হয়েছে। সুতারং আমরা যদি পরপর কয়েকটি ভালো নির্বাচন অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তা হলে বিদেশিরা আর তৎপর হবে না। বিদেশিরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলে কারণ তাদের এখানে অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। তারা চায় না রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হোক। অতীতেও নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ২০০৬-০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল দৃশ্যমান। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ও বিদেশি দূতাবাসগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতেও একই চিত্র। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, কানাডা, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ডসহ বহু দেশের কূটনীতিক বৈঠক করেছেন। নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত জাতীয় নাগরিক পার্টিÑ এনসিপির সঙ্গেও বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যোগাযোগ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো ও পাকিস্তানের কূটনীতিকরা এরই মধ্যে এনসিপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে তারা জুলাই সনদ, সংস্কার প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মতবিনিময় করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর বাসায় তিন নর্ডিক দেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক নিয়েও চলছে আলোচনা। যদিও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন একে ‘স্বাভাবিক কূটনৈতিক সৌজন্য’ বলে মন্তব্য করেছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com