বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:৫৮ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক॥
ঈদুল আজহা ঘনিয়ে আসার সাথে রাজধানীতে কোরবানির পশুর বাজারও জমতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিনের ক্রেতাশূন্য বাজার এবার সরগরম হয়ে উঠছে। ইজারাদাররা বলছেন, বেচাকেনা শুরু হতে আরও দুয়েকদিন সময় লাগলেও এরই মধ্যে মোটামোটি ভাবে জমে উঠেছে বাজার।
ক্রেতারা হাটে ঘুরে ঘুরে গরু, ছাগল, মহিষসহ বিভিন্ন কোরবানির পশু দেখছেন এবং দাম যাচাই করে কিনছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরবানির পশু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারীরা। ক্রেতারাও দাম যাচাই বাছাই করে কোরবানির পশু কিনছেন। সারা দেশ থেকে বিক্রির জন্য গরু নিয়ে বিক্রেতারা রাজধানীর ১৯ টি হাটে শুরু হয়েছে বেচাকেনা। গরু বিক্রির ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী বিক্রেতারা।
শুক্রবার ৩০ মে ছুটির দিনের বিকেল থেকে বেচাকেনা জমে ওঠেছে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। ক্রেতার সামনে নজর কাড়তে গরুকে ধুয়ে-মুছে গোসল করিয়ে এবং খাবার খাইয়ে প্রস্তুত করতে দেখা গেছে।
শনিবার ৩১ মে থেকে পুরোদমে গরু বিক্রি শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। ঢাকার বিভিন্ন পশুর হাট ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। মানুষের সক্ষমতার সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে বেড়েছে কোরবানির পশু বিক্রির সংখ্যা। চাহিদার সঙ্গে বড় হয়েছে এ বাজার। গত কোরবানি ঈদে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছিল। তবে এবার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক টানা পড়েনকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে এ বাজার খানিকটা সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা করেছেন পশু পালনের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মানুষের সীমিত আয়ের সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এক শ্রেণির মানুষকে পশু কোরবানি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে।
আবার যেসব মানুষ বেশি ব্যয় করে কোরবানির পশু কিনত সেটা এবার কমিয়ে ফেলতে পারে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিগত সরকারের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি পলাতক ও আত্মগোপনে থাকায় কোরবানি পশু কিনবেন না। ফলে সেই প্রভাব পড়বে বাজারে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির মতো দলগুলোর নেতৃস্থানীয়রা সেই গ্যাপ পূরণে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, গত বছর ১ কোটি ৪ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে, যেখানে ১ কোটি ২৯ লাখের বেশি পশুর সরবরাহ ছিল। এ বছর ১ কোটি ২৪ লাখ কোরবানির পশুর সরবরাহ রয়েছে। তবে কোরবানি পশুর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে কম হওয়ার ধারণা করছেন উদ্যোক্তারা। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, গত বছর ১ কোটি ৪ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে, যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৬৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছে, দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে স্থবিরতা, ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধারণ মানুষের আয় না বাড়ার একটা চাপ পড়তে পারে এবারের কোরবানিতে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘পরিবেশটা অস্থির, অন্যদিকে দীর্ঘদিনের উচ্চ মূল্যস্ফীতি। প্রতি বছর ইফেকটিভ চাহিদা হিসেবে ৫ শতাংশ পর্যন্ত পশুর বাড়তি চাহিদা হিসেবে করা হয়, এবারে হয়তো সেটা নাও বাড়তে পারে। আর্থিক চাপের কারণে অনেকেই হয়তো মাঝারি-ছোট গরুতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। গত বছর অনেক পশু উদ্বৃত্ত ছিল। তিনি বলেন, খাদ্য, কর্মচারীর বাড়তি খরচ এবং বাড়তি ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের কারণে পশু পালনের সামগ্রিক খরচ এবারও বাড়তি থাকবে। যে কারণে কোরবানির পশুর দাম স্বাভাবিক ভাবেই একটু বাড়বে, তবে খামারি বা পশুপালকরা যদি অতিরিক্ত দাম নির্ধারণ করেন, সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। এবার তারা যদি পশু পালন ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে অল্প লাভে পশু বিক্রি করেন, সেটা বাজারের জন্য ইফেকটিভ হবে।
খামারিরা বলছেন, উৎপাদন ব্যয়ের কারণে প্রতি বছর পশুপালনে খরচ বৃদ্ধি পায়। যার একটা প্রভাব বাজারে থাকে। তবে যেসব পরিবারে দুই-পাঁচটি গরু পালন করা হয় তারা দামটা একটু বেশি লাভের আশা করেন। এটাও বাজারে একটা প্রভাব রাখে। গত বছর ঢাকার বাজারে লাইভ ওয়েট হিসেবে বিভিন্ন আকারের গরু বিক্রি হয়েছে ৪৮০-৫৫০ টাকা কেজি দরে। গত বছর ঢাকার বাজারে গরু বিক্রি করতে আসা খামারিদের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন আকারের গরু বিক্রি হয়েছে ১০-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে। অনেক ছোট আকারের গরুই কিনতে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে। সেটা এবার হয়তো আরও একটু বেশি দামে বিক্রি হবে।
বাংলাদেশে কয়েক লাখ খামারি রয়েছেন, যারা এখন বাণিজ্যিক ভাবে পশুর খামার পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে হাজার পাঁচেক খামারি রয়েছেন যারা ৪০-৫০ বা তারও বেশি পরিমাণে গরু পালন করছেন। এর বাইরে দুই-পাঁচটি গরু পালন করেন সারা দেশের এমন গৃহস্থ পরিবার গুলো থেকেই কোরবানির বাজারে ৭০ ভাগ পশু আসে। বাংলাদেশ ডেইরি অ্যান্ড ফ্যাটেনিং ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রামের ডেইরি খামারি মালিক ওমর বলেন, উৎপাদন ব্যয়ের কারণে স্বাভাবিক ভাবেই পশু পালন খরচ এখন বেশি, যদিও গত এক মাসে ফিডের দাম খানিকটা কমেছে।
তবে কর্মচারীর ব্যয়, বিদ্যুৎ, পরিবহন সব খরচই বেশি। যেটা গরুর দামে প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কোরবানিতে যতটা প্রভাব ফেলবে, তার চেয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি চাপ তৈরি করবে। তবে কোরবানির পরিমাণ সামগ্রিক ভাবে খুব বেশি কমবে বলে মনে হয় না। হয়তো অনেক বড় গরুর চাহিদা কম থাকবে, কিন্তু ছোট ও মাঝারি গরুর বিক্রি বেড়ে যেতে পারে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে এবারে পশুর হাট বসবে ১৯টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৯টি এবং উত্তর সিটির ১০টি স্থানে পশুর হাট বসবে। ঈদের আগের তিন দিনসহ পাঁচ দিন চলবে পশু বেচাকেনা। এবারে আফতাব নগর ও মেরাদিয়া পশুর হাট বাদ পড়েছে।