বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৩ অপরাহ্ন
ফরিদ আহমেদ, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি:: স্বাস্থ্য সহকারীসহ ১১৫টি পদে কুষ্টিয়ায় নিয়োগ বাণিজ্যের তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। ২০২৪ সালের ২৩ এপ্রিল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর শুরু হয়ে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ১৫ মাসে এই বাণিজ্য করেছেন নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতরা। এ সময় ১১ থেকে ২০তম বেতন গ্রেডের দুই শতাধিক চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করা হয়েছে। এই নিয়োগ বাণিজ্য সফল করার প্রথম ধাপেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ফেঁসে গেছেন সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমনই প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন জানান, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নিয়োগ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম স্থগিতসহ বাতিল ঘোষণার সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।
গত ২৭ অক্টোবর সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগ ও দুদকের যৌথ তদন্তকারী দলের হাতে উঠে আসা তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২৩ অক্টোবর দুপুরের পর থেকে ২৪ অক্টোবর নিয়োগ পরীক্ষার দিন সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঘটনা বিশ্লেষণে নিয়োগ বাণিজ্যের তথ্য উঠে আসে। ঘটনার দিন সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং শহরের কোর্টপাড়ার হাসপাতাল মোড়ের কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে সবকিছু স্পষ্ট হয়েছে। এসব ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে বিএনপি ও সাবেক ব্যাংক সিবিএ নেতা কুতুব উদ্দিনের ছেলে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডাক্তার হোসেন ইমাম ও তার বড় ভাই স্বাস্থ্য সহকারী হাসান ইমাম নান্নুর বাড়ি এবং তার মালিকানাধীন নিউ সান প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে।
সেই সাথে ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত নিয়োগ কমিটির কয়েকজন সদস্য এবং তাদের পারিপার্শ্বিক গতিবিধি ও আচরণের মধ্যেই প্রশ্ন ফাঁসের সকল তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও দুদকের যৌথ তদন্তে জব্দ করা আলামতে প্রাথমিকভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা প্রমাণ এবং জড়িতদের শণাক্তকরণে যথেষ্ট বলে মনে করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও, এই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার আন্দোলনে জেলাজুড়ে তোলপাড় হওয়ায় রাষ্ট্রীয় সকল গোয়েন্দা সংস্থা জড়িতদের খুঁজে বের করতে মাঠে নেমেছে। এসব তদন্তকারী সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন অনুসন্ধানী কৌশল অবলম্বন করলেও উদঘাটিত তথ্য প্রমাণে সাদৃশ্য রয়েছে বলে অভিমত তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ২৩ অক্টোবর রাত ১০টার পূর্বে ও পরে সিভিল সার্জন কার্যলয়ের সিসি ক্যামেরার কিছু ফুটেজে বেশকিছু সন্দেহজনক বিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর সাথে প্রশ্ন ফাঁসের আলাতম পাওয়া যায়-যার সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজের যোগসূত্র রয়েছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ওয়েভ সিস্টেম/ওয়াইফাই এর সুইচ অফ থাকলেও প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির কয়েকজন ব্যক্তির নিয়ম বহির্ভুত ব্যক্তিগত ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। ওই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য রয়েছে, নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৬ হাজার ৭শ ৮৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে দুই শতাধিক প্রার্থীর কাছে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে এই পশ্নপত্র প্রেরণ করা হয়।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জনবল নিয়োগে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট নিয়োগ কমিটি কাজ করে। সদস্যরা হলেন-খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডাক্তার মুজিবুর রহমান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-সচিব শাহাদত হোসেন কবির, পিএসসি খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক নাসরিন সুলতানা, কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন এবং কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাহাঙ্গীর আলম।
এই নিয়োগ কমিটিই ২৩ অক্টোবর দুপুর থেকে বিরতিহীনভাবে ২৪ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত প্রশ্ন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করে। কঠোর নিরাপত্তা ও শতভাগ গোপনীয়তা সুরক্ষায় বিধি অনুযায়ী এ ধরনের দায়িত্ব পালনকালে কেবলমাত্র অনুমোদিত প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জাম ব্যবহার ব্যতিরেকে কর্তব্যরত ব্যক্তিরা সকল প্রকার নেটওয়ার্ক ও ডিভাইস বিচ্ছিন্ন থাকবেন।
পিএসসি খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক নাসরিন সুলতানা মুঠোফোনে বলেন, ঘটনার দিন কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জনবল নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নকালে স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি কাজের চাপ থাকায় আমি নিজেও খুব ব্যস্ত ছিলাম।
বিধি মতে, এসব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকালে কর্তব্যরত কারোরই ব্যক্তিগত কোন ডিভাইস ব্যবহার করার কথা না। আমার নিজের ডিভাইস/মোবাইলটাও জমা দেওয়া ছিল। এসময় সেখানে কেউ মোবাইল বা ব্যক্তিগত ডিভাইস ব্যবহার করেছেন কি না সেটা আমি বলতে পারবোনা।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-সচিব শাহাদত হোসেন মুঠোফোনে বলেন, এ মুহূর্তে এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না। পরে অন্যকোন সময় কথা বলা যাবে। নিয়োগ কমিটির অপর সদস্য কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাহাঙ্গীর আলমের মুঠোফোনে দুই দিন ধরে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। কল রিসিভের অনুরোধ করে খুদে বার্তা দিলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।
পরে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বা প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটিকে গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।