সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ১১:৩২ অপরাহ্ন
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি:: বিয়ের ১১ মাসের মাথায় মাত্র ১৯ বছর বয়সে এক প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার কারনে খাদিজা আক্তার তানিয়া নামের ওই প্রসূতি মারা গেছেন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালে ঘটনাটি ঘটেছে। গত শুক্রবার সেখানে তার সিজার করে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করানো হয়। এরপর রোগীকে দুই ঘন্টা পর অপারেশন টেবিল থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। ঢামেকে তার আরেক দফা অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর শনিবার বেলা ১১ টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন খাদিজা।
খাদিজার দেবর হাসান বলেন, ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসার কারনে আমার ভাবীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। এটা ছিল তাদের প্রথম সন্তান। ভাবীর অকাল প্রয়ানে ভাই শয্যাশায়ী।
খাদিজার স্বজনরা জানান, রোগীর ক্ষতি যা হওয়ার ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালে সিজারের সময় সেটা হয়েছে। রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানকার ডাক্তাররা জানিয়েছেন সিজার করার সময় রোগীর রক্তনালি বেশি পরিমানে কেটে ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায় রোগীকে সেলাই না দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে থাকে। পরে ঢামেক কর্তৃপক্ষ রোগীকে বাঁচাতে আরেক দফা অস্ত্রোপচার করলেও খাদিজাকে বাঁচানো যায়নি। এতে ক্ষুব্ধ স্বজনরা শনিবার রাতে ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে বিক্ষোভ ও সামান্য ভাংচুর করে।
অভিযোগ উঠেছে এই হাসপাতালে খাদিজার মতো অনেককেই ভুল চিকিৎসার কারনে প্রান হারাতে হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জাকিয়া আক্তার বলেন, গত বছর এদের ভুল চিকিৎসার কারনে আমার বান্ধবীর মেয়ে মারা গেছে। আড়াকুল এলাকার গৃহিনী আখি খান বলেন, ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ভালো না। ভুলভাল রিপোর্ট দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়।
ভুক্তভোগী সাব্বির হোসেন বলেন, রোগী নিয়ে এরা ব্যবসা করে। ষ্টাফদের ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ। এখানে অনভিজ্ঞ ডাক্তারদের চেম্বার বেশি। যন্ত্রপাতি পুরনো, ভালো রিডিং (সঠিক রেজাল্ট) আসে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে রায়হান মিয়া নামে এক ব্যক্তি ইকুরিয়া এলাকায় এই ক্লিনিকটি গড়ে তোলেন। তিনি এক সময় সাজেদা হাসপাতালে চাকরি করলেও হঠাৎ সেই চাকরি ছেড়ে নিজেই ক্লিনিক খুলে বসেন। বিগত সরকারের সময় আওয়ামী লীগের তোষামোদী করে কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদকে ‘তেল’ দিয়ে উপজেলা বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতাল কমিটির সাধারন সম্পাদক হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালের সাবেক এক কর্মচারী বলেন, এই হাসপাতালের বেশিরভাগই অদক্ষ জনবল। মালিক রায়হান কম বেতন দিয়ে এদের রেখেছেন। এছাড়াও সে (মালিক) হাসপাতালে সুদের ব্যবসা করেন। রোগীদের বাধ্য করেন ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্ড’ করতে। নানা প্রলোভন দেখান স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্ড করলে চিকিৎসায় সেবায় খরচে ছাড় পাওয়া যাবে। এভাবে শত শত লোকের কাছ থেকে সে আমানত সংগ্রহ করলেও পরে আর ফেরত দেন না। তিনি আরও জানান, এই হাসপাতালে ডা: জসিম উদ্দিন নামে একজন চিকিৎসক বসে। আসলে সে চিকিৎসক নন। রায়হান মিয়ার লোক। সে ডাক্তার পরিচয়ে রোগী দেখে। এই ডাক্তার রায়হানের কথামতো রোগীদের অতিরিক্ত টেষ্ট করিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামালপুরের দরিদ্র ঘরের সন্তান রায়হান মিয়া সাজেদা হাসপাতালে চাকরি করতেন ২৫/৩০ হাজার টাকা বেতনে। সেখানে থাকা অবস্থায় সে ২০০৭ সালে কেরানীগঞ্জ ৪ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি করেন। এরপর ২০১৪ সালে সেই চাকরি ছেড়ে কোটি টাকা দিয়ে গড়ে তোলেন ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতাল। এই হাসপাতাল ও ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্ড’ এর ব্যবসা করে গত এক দশকে তিনি হাতিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।
এদিকে গৃহবধূ খাদিজার মৃত্যুর ঘটনাটি আলোচিত হলে রোববার ঢাকা জেলা সিভিল সার্জনের একটি টিম ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আক্তার হোসেন জানান, খাদিজার পরিবার অভিযোগ নিয়ে এসেও ফিরে গেছে। শুনেছি বিষয়টি তারা আপোস মীমাংসা করে ফেলেছে। খাদিজার সিজারের অস্ত্রোপচার করেছেন ডা: আনিসা ফাহমিদা। অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হাসপাতালে গিয়েও তার দেখা মেলেনি।
হাসপাতালের মালিক রায়হান মিয়া বলেন, ওই রোগী কার্ডিয়াক এরেস্টে মারা গেছেন। তার পরিবার তো বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। তাদের কোন অভিযোগ নেই। আপনারা (সাংবাদিকরা) কেনো মাথা ঘামাচ্ছেন?
ভুয়া ডাক্তারকে চেম্বার দেয়া, বেশি বিল নেয়া, সম্পদ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোন সদুত্তর দেননি।