শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৮ অপরাহ্ন
ফিচার ডেস্ক:: গরম পানীয় হিসেবে বিশ্বজুড়ে রয়েছে চা-কফির ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে চা ও কফির প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া জাতি আমরা। সর্বত্রই এই দুই পানীয়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিয়মিত দিন গুজরান করছেন কোটি কোটি বাঙালি। চা-কফি কর্মস্থলের কঠিন সময়ে যেমন ক্লান্তি দূর করে, তেমনই সকাল-দুপুর আড্ডার অপরিহার্য অংশ এই পানীয়। বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা পারিবারিক আড্ডা চা-কফি ছাড়া বেসুরো অনেকের কাছে। তবে মুশকিল হলো, বেশি পরিমাণে চা-কফি পান করা অনেকের কাছে নেশার মতো হয়ে যায়। অনেকে মনে করেন চা-কফি পান করলে ঘুম চলে যায়। ক্লান্তি দূর করতে এই পানীয়ের স্বাদ নেন অনেকেই। তবে জেনে নিন কোন পানীয়টি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে।
চা তে সাধারণত কফির তুলনায় ক্যাফেইনের পরিমাণ কম থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়ের ফুড ডেটা সেন্ট্রাল ডেটাবেস অনুসারে, ঘরে তৈরি কফির প্রতি ৮ আউন্সের কাপে গড়ে ৯২ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। কফি শপের ১২ আউন্সের কাপে ১৫০ থেকে ২৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। অন্যদিকে ৮ আউন্সের ব্ল্যাক টিতে ৪৭ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে এবং সমপরিমাণ গ্রিন টিতে প্রায় ২৯ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে।
খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ক্যাফেইন গ্রহণ নিরাপদ এবং এর স্বাস্থ্যগত সুফলও পাওয়া যায় বেশ। ক্যাফেইন শক্তি ও মনযোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এতে বিষণ্নতা, পারকিনসন্স রোগ (এক ধরনের স্নায়বিক রোগ), যকৃতের রোগ, হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
বেশি মাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণ অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতা বা দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। দিনের শেষভাগে অতি মাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে নিদ্রাহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। এই ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে যে স্নায়বিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তাতে আসক্তি তৈরি হতে পারে।
উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইন থাকার ফলে কফি পানে তাৎক্ষণিক স্ফুর্তি অনুভূত হলেও চায়ে বিদ্যমান এল–থিয়ানাইন (এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ) ক্যাফেইনের সঙ্গে মিলে তুলনামূলক দীর্ঘক্ষণ মানসিকভাবে সচেতন থাকতে সাহায্য করে।
সহজভাবে বলতে গেলে কফি অল্পসময়ে দ্রুত তরতাজা অনুভূতি এনে দিলেও চায়ের প্রভাব ধীরে তবে দীর্ঘস্থায়ী হয়।
চা ও কফি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। তবে এ দুটোতেই পলিফেনল নামের এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ আছে। তবে কফি বা চা প্রক্রিয়াজাত ও তৈরির ভিন্নতার কারণে পলিফেনলের পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে।
কফি, চা ও রেড ওয়াইনের মতো মদজাতীয় পানীয়র ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসপ্রেসো কফিতে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে। তবে, ২০২২ সালের এক জরিপ অনুসারে, গ্রিন টিতে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের উপস্থিতি সর্বোচ্চ। অর্থাৎ কফি ও চা দুটোতেই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী উপাদান আছে।
ক্যাফেইনের উপস্থিতি না থাকলেও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকার কারণে চা ও কফিতে রোগ প্রতিরোধকারী গুণ রয়েছে। নিয়মিত চা পানের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং মুখ ও পরিপাকতন্ত্রের ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
কফিরও স্বাস্থ্যগত কয়েকটি সুফল রয়েছে। কফির ওপর ২০১টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কফি পানে হৃদরোগ, স্নায়বিক, বিপাকীয় ও যকৃতের রোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে। কফি লিউকোমিয়া, প্রোস্টেট, জরায়ু ও ত্বকের ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর সঙ্গেও সম্পর্কিত।
তবে, রোগ প্রতিরোধের জন্য অবশ্যই চা বা কফির ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। গবেষণা বলছে, সুষম খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রেই চা বা কফি উপকারী হতে পারে।
কফি ও চায়ের ইতিবাচক প্রভাব ছাড়াও বেশ কয়েকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। কফি গ্রহণের ফলে গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। জন্মের সময় সন্তানের ওজন কমে যেতে পারে এবং গর্ভধারণের চতুর্থ থেকে নবম মাসের মধ্যে গর্ভপাত হতে পারে। কফি গ্রহণের ফলে নারীদের মধ্যে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
চিকিৎসকেরা বলছেন, কফি গ্রহণের ফলে নারীদের গর্ভপাতের কারণ হলো কফিতে উপস্থিত ক্যাফেইন। তাই উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন মিশ্রিত চা পানেও একই ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। আমেরিকার প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যা কলেজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দৈনিক ২০০ মিলিগ্রামেরও (যা ঘরে তৈরি ২ কাপ কফির সমান) কম ক্যাফেইন গ্রহণে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে না। তবে, ক্যাফেইন গ্রহণের পরিমাণ সঙ্গে কম ওজনের শিশু জন্মানোর সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলা হয়নি।
চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী অস্টিওপরোস ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কোনো নারী দৈনিক ৪ কাপের বেশি কফি পান করলে তাঁর হাড়ে ফাটল ধরার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারো হাড়ের ক্ষয়রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তাঁর কফি গ্রহণের এ দিকটি মাথায় রাখতে হবে।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে স্নায়বিক দুর্বলতা ও নিদ্রাহীনতা অন্যতম।
চা বা কফি স্বাস্থ্যে কেমন প্রভাব ফেলবে তা নির্ভর করে এদের সঙ্গে কী মেশানো হচ্ছে তার ওপর। চা বা কফির সঙ্গে চিনি, ক্রিম, প্রক্রিয়াজাত দুধ বা দুগ্ধজাতীয় বা মিষ্টাণ্ন যুক্ত করার ফলে তা স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে ক্যালরির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এ উপায়ে প্রতিদিন চা কফি গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতে চা, কফি এড়িয়ে চলাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ এসব পানীয়ে থাকা ক্যাফিন রাতের ঘুম নষ্ট করে। এমনকি বারবার পেতে পারে প্রস্রাবও। তাই রাতে চা বা কফি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। তবে সন্ধ্যাবেলায় অনায়াসে চা-কফি চলতে পারে। এতে কোনো অসুবিধা নেই।
বিশেষজ্ঞদের মত, চা ও কফি যতই উপকারী পানীয় হোক না কেন, দিনে ২ থেকে ৩ কাপের বেশি খাওয়া উচিত নয়। কারণ, এতে শরীরে বিপাকের হার বিঘ্নিত হতে পারে। ফলে খিদের ইচ্ছা চলে যায়। অতিরিক্ত চা-কফি পান করলে দেহে আয়রন শোষণও হবে না। ফলে অ্যানিমিয়ার ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা বাড়ে।