শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩৫ পূর্বাহ্ন

খেলাপি ঋণের ৪৪ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের

খেলাপি ঋণের ৪৪ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক:: ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বড় অংশই হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত। এ তালিকায় এগিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৪০ শতাংশের বেশি খেলাপির খাতায় উঠেছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে তাদের খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এটি দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৪ শতাংশ। মাত্র তিন মাসে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে জনতা ব্যাংকের।

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। তাদের শর্ত মেনে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামানোর কথা। তবে ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টোটা। খেলাপি ঋণ না কমে বরং লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এ ছাড়া কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে চলে গেলে এটিকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের জন্য অ্যালার্মিং (উদ্বেগজনক) হিসেবে দেখা হয়। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি গত সাড়ে ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণেও ঋণ পরিশোধ কমে গেছে। এতে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা ওই সময় বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ ছিল। আর গত মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ, তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বেড়েছে। আর ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১২ কোটি টাকায়, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তিন মাস আগে গত জুনে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। গত তিন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। গত জুনে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা বা প্রায় ৬১ শতাংশ। মূলত বিতর্কিত এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের অধিকাংশই খেলাপির খাতায় ওঠায় তাদের খেলাপি বেড়েছে।

আলোচ্য তিন মাসে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। গত জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে যা বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, তিন মাসেই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির কয়েকটি বড় গ্রাহকের ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত তিন মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। এ সময়ে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। গত জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটির গ্রাহক বেক্সিমকো, জিএমজি এয়ারলাইসসহ কয়েকটি বড় গ্রুপের ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েছে।

এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।

বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণের হারে এখনও শীর্ষে রয়েছে বেসিক ব্যাংক। গত জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা বা ৬৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সামান্য বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯৭৮ কোটি টাকা বা ৩৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তিন মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৯৪৩ কোটি টাকা বা ৪২ দশমিক ৩০ শতাংশ।

প্রভিশন ঘাটতিও বেড়েছে: খেলাপি ঋণ বেশি বৃদ্ধির কারণে গত সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বড় ধরনের প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ে। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ৪০ হাজার ২০৪ কোটি টাকা, গত জুন প্রান্তিকে যা ছিল ১১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, তিন মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com