শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২৫ অপরাহ্ন
রাজশাহী প্রতিনিধি:: এবছর রাজশাহীতে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ধান উৎপাদন হয়েছে। আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এখন মাঠজুড়ে দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। জ্যৈষ্ঠ মাসজুড়ে পুরোদমে চলবে সোনালি ফসল বোরো ধান কাটা-মাড়াই ও ঘরে তোলার ব্যস্ততা। ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ জমির ধান ঘরে তুলেছেন চাষিরা।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রবিশস্য তুলতে দেরি হওয়ায় এবার বোরো আবাদের সময় কিছুটা এদিক-সেদিক হয়েছে। অধিকাংশ চাষি দেরিতে ধান লাগিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল গরমের নেতিবাচক প্রভাব। পানির সংকটে রোপণ নিয়ে ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তবে সব উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা মাড়িয়ে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি জমিতে ধান আবাদ হয়েছে। এখন ফসল ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা।
জেলার কৃষকরা জানিয়েছেন, এবার রবিশস্য ঘরে তোলা শেষে বোরো রোপণের প্রস্তুতি নিতে দেরিতে হয়েছে কৃষকদের। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে অনেকের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার নতুন করে বীজতলা তেরি করে রোপণ করতে দেরিতে হয়েছে। পাশাপাশি বৃষ্টি না হওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এ বছর সার ও কীটনাশকের দামও বেশি। উৎপাদন ভালো হলেও লাভ নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত এক দশকে জেলায় বোরো উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এবার এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৫ হাজার ৮৩৪ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ৭১ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৭৩২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৮ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৮৬ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭০ হাজার ১০৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৯৭ হাজার ৬৬৩ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল লাখ ৯৩ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬৭ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ৮৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৬২ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৭৭৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয়েছিল দুই লাখ ৯৪ হাজার ১৫ মেট্রিক টন ধান। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ০৮৬ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৬৯ হাজার ৫৪৪ মেট্রিক টন এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ০৪৫ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ৭৬ হাজার ৩২৬ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছিল। এই সময়কালে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪.০৬ মেট্রিক টন থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে ৪.৮৫ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।
চলতি মৌসুমে ৭০ হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৪৬ হাজার ৭০ মেট্রিক টন চাল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি, যেখানে উৎপাদন হয়েছিল তিন লাখ ৩২ হাজার ৪৩৯ মেট্রিক টন চাল। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে এক হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন; উৎপাদনে বেড়েছে ১৩ হাজার ৬৩১ মেট্রিক টন।
চাষিরা জানিয়েছেন, বোরো চাষে সেচের খরচ অনেক বেশি। বৃষ্টি হলে সেচের খরচ কিছুটা কমে। এ বছর বীজতলা তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। আগাম বীজতলা যারা তৈরি করেছেন, তাদের অনেকের চারার মান খারাপ হয়েছে। এ ছাড়া সার ও কীটনাশকের দাম বেশি। তবু উৎপাদন ভালো হয়েছে।
এ বছর আড়াই বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছেন গোদাগাড়ী উপজেলার শফিকুর রহমান। জমি উঁচু হওয়ায় সেচের খরচ বেশি পড়েছে জানিয়ে এই কৃষক বলেন, ‘অন্যান্য খরচও এবার বেশি হয়েছে। অসময়ের বৃষ্টিতে পুরো ধান জমিতে শুয়ে পড়েছিল। এতে ক্ষতি হয়েছে। আবার ধানের রংটা ঠিকমতো আসেনি।’
উঁচু জমি হওয়ায় দুই-তিন দিন পরপর সেচ দিতে হয়েছে জানিয়ে পবা উপজেলার চাষি আনসার আলী বলেন, ‘এবার সেচ দিতে গিয়ে অস্বাভাবিক ব্যয় হয়েছে। এখনও ধান জমিতে কয়েকদিন থাকবে। ফলন কাঙ্ক্ষিত হবে না। আবার খুব খারাপ হবে এমনটাও না। তবে লাভের মুখ হয়তো দেখতে পাবো না।’
তবে গত বছরের তুলনায় এবার ভালো ফলন হয়েছে জানিয়ে মোহনপুর উপজেলার তিলাহারি গ্রামের কৃষক এনামুল হক বলেন, ‘আগাম পাকায় আগে কেটে ঘরে তুলেছি। তবে সব স্থানে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়নি। আমার ফলন খুব ভালো হয়েছে। প্রতি বিঘায় প্রায় ২৬ মণ হারে হয়েছে। এতে আমি খুশি।’
মোহনপুরে সাত হাজার ৪০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে বলে জানালেন মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাকিমা খাতুন। অধিকাংশ ধান পেকে গেছে উল্লেখ করে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সাত শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে কাটা শুরু হবে। আশা করছি, ভালো ফলন হবে।’
১৫ মে পর্যন্ত ৩০ শতাংশ ধান চাষিরা ঘরে তুলেছেন বলে জানিয়েছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা উম্মে ছালমা। তিনি বলেন, ‘এবার ধান ঘরে তুলতে একটু বেশি সময় লাগবে। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফলন বিপর্যয়ের কোনও খবর পাইনি। আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রার বেশি উৎপাদন হবে।’