সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:০০ অপরাহ্ন

৮ বছরেও বদলায়নি রোহিঙ্গাদের ভাগ্য

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ছবি- সংগৃহীত

একুশের কণ্ঠ অনলাইন:: জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার আট বছর পরও মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং গেল বছর থেকে রাখাইন রাজ্যের দখল নিতে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্ঘাতের মধ্যে পড়ে রোহিঙ্গাদের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে গেছে। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর পর এখন রাখাইন রাজ্যের বেশির ভাগ দখলে নেয়া আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। তাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে নতুন করে দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। এ ছাড়া আরো হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি দেয়ার জন্য সীমান্তে জড়ো হচ্ছে বলে খরব পাওয়া যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সরকারের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি হলেও আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএইডের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা দেয়ার সাথে জড়িত ইউএসএইড সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম সীমিত বা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। ইউক্রেন, গাজাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সঙ্ঘাতের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে গতকাল কক্সবাজারে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে। আজ সোমবার এতে যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সম্মেলনে দেশী-বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথি, বিশেষজ্ঞ ও রোহিঙ্গাদের মতামতের ভিত্তিতে সরকার একটি অবস্থানপত্র তৈরি করবে। আগামী সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনের সাইড লাইনে অনুষ্ঠেয় রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে বাংলাদেশ এই অবস্থানপত্র উত্থাপন করবে। জাতিসঙ্ঘ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান, মানবিক তহবিল সংগ্রহ ও রাখাইনে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরে কাতারের রাজধানী দোহায় রোহিঙ্গাবিষয়ক অপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরিচালিত মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের কারণে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের জনস্রোতের আট বছর পর পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসঙ্ঘ। গত শুক্রবার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এক বিবৃতিতে জানান, মিয়ানমারের ভেতরে থাকা এবং বিদেশে নির্বাসিত উভয় রোহিঙ্গারাই দিন দিন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। আট বছর পরও তারা আরো অবনতিশীল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। চলমান সহিংসতার কারণে আরো বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের অনেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে যাওয়া ১১ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ বসবাস করছেন।

ডুজারিক সতর্ক করে বলেন, এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের জোর করে ফেরত পাঠানো বা সীমান্তে বাধা দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে, যা আন্তর্জাতিক নীতি লঙ্ঘনের গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করছে এবং শরণার্থীদের আশ্রয়ের সুযোগ সঙ্কুচিত করছে। তহবিল সঙ্কটের কারণে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, খাদ্যসহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবনধারণের সুযোগ এবং সুরক্ষা পরিষেবাগুলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

মুখপাত্র জানান, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, মানবিক ও শরণার্থী আইন অনুযায়ী সব বেসামরিক নাগরিককে সুরক্ষা দেয়ার জন্য তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ বছরের শুরুতে গুতেরেস কক্সবাজার সফর করে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেছেন। মহাসচিব সেখানে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সহনশীলতা দেখেছেন এবং আন্তর্জাতিক সংহতি জোরদার ও সমর্থন বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

স্টিফেন ডুজারেক বলেন, এই সঙ্কটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে একটি ব্যাপক রাজনৈতিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে, যেখানে রোহিঙ্গাদের অর্থপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যায়। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের নির্দেশনায় আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু বিষয়ে যে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা একটি স্থায়ী সমাধানের প্রয়োজনীয়তার দিকে বিশ্বের মনোযোগ ফেরাতে সাহায্য করবে।

জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে সব পক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে মুখপাত্র বলেন, তিনি মিয়ানমারের নেতৃত্বে একটি কার্যকর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন, যা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সাথে টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবে।

অপর এক বিবৃতিতে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর অব্যাহতভাবে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। তিনি বলেন, সহিংসতার চক্র ভাঙতে দায়মুক্তির অবসান এবং রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপত্তা, সমতা ও নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানবিক তহবিল সঙ্কটের কারণে মিয়ানমার ও বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তার ব্যাপক কাটছাঁট করা হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরো নজুক করে তুলেছে।

বিবৃতিতে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রধান রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য মানবিক তহবিল বাড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি একই সাথে রোহিঙ্গাদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক সমর্থন চেয়েছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com