বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫, ১২:৪২ পূর্বাহ্ন
আহমদ রফিক:
আমরা ইতিপূর্বে কথাটি বলেছি- ২০১৮ সালটি রাজনৈতিক বিচারে নির্বাচনী বছর হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। ইতিমধ্যে শুধু নিম্নস্তরেই নয়; কয়েকটি সিটি করপোরেশনেও ভোট পর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং যথারীতি পরাজিত দলের প্রতিবাদ ও ফলাফল প্রত্যাখ্যান। এটা আমাদের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছুকাল থেকে। আমরা কিছুতেই রাজনীতির কিছু ক্ষেত্রে রাহুর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারছি না।
রংপুরের পর খুলনা নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ ও পাল্টা জবাব, অনেক কাটাছেঁড়ার পর সবার একই বক্তব্য- পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে যেন অভিযোগের সুযোগ না থাকে; নির্বাচন যেন রীতিমাফিক অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নিয়ে তাই সবারই ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
আমরা জানি, সঠিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার সম্পূর্ণ দায় নির্বাচন কমিশনের। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক দায় প্রহরায় নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সবারই লক্ষ্য হবে, নির্বাচনে যাতে নিয়মনীতির বরখেলাপ না হয়, তা নিশ্চিত করা। পরোক্ষ দায় সরকারের। কারণ তাদের শাসন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্তিত্ব নেই। এমন এক রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আবারও সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা গাজীপুরে। হিসাব-নিকাশ বলে, সেখানে মানবিক-রাজনৈতিক দিক বিচারে আওয়ামী লীগ সমর্থনের প্রাধান্য, যদিও একবার নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন।
দুই. এখন প্রশ্ন- কেমন হয়েছে এ নির্বাচন? সঠিক, অবাধ, সুষ্ঠু, পক্ষপাতহীন? আজকের (২৭ জুন) সংবাদপত্রগুলোতেও এ বিষয়ে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রকৃতির সংবাদ প্রতিবেদন। তবে কাল রাতে বিভিন্নভাবে আলোচনায় যে বিচার-ব্যাখ্যা শুনেছি, তাতেও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই মতামত প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে এক-আধজন খুবই পরিচিত মুখেরও উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তিনজনের মধ্যে একজন একটু ভিন্ন সুরে কথা বলতে চেষ্টা করেছেন। তারা অবশ্য স্বীকার করেছেন, খুলনার মতো গাজীপুরেও কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। যে জন্য কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গণনা বন্ধ। তবে সার্বিক বিচারে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ ফলাফল গ্রহণযোগ্য।
তবে এ কথাও সেখানে বলা হয়েছে, অংশত হলেও এই যে সংঘাতময় ভোট পর্ব পরিস্থিতি, অভিযোগ এবং তা পাল্টা নাকচ- এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ভোটারদের মনে। তখন তাদের মনে হয়, ভোট যদি একপেশে হয়, তাহলে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তেতে-পুড়ে ভোট দেওয়ার চেষ্টা করে লাভ কী? এটা গণতন্ত্রী রাজনীতির জন্য মোটেই শুভ বা ইতিবাচক নয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে কীভাবে বেরিয়ে আসা যাবে, এমন সব পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী, সে ক্ষেত্রে সঠিক দায়পূরণ কীভাবে হতে পারে, সেসব দিকনির্দেশনা সেখানে খুব একটা মেলেনি। এবার দেখা যাক আজকের অর্থাৎ ২৭ জুনের দৈনিকগুলোতে কী খবর, কী প্রতিবেদন বা কী মতামত প্রকাশিত হয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের বিচার-বিবেচনাই-বা কী?
তিন. প্রথমে শিরোনামগুলোর দিকে তাকানো যাক, পরে তার অন্তর-বাহির নিয়ে কথা। একটা দৈনিকের প্রথম পাতায় মোটা অক্ষরে লিড কলামের শিরোনাম :’নিয়ম-অনিয়মের নির্বাচন’। পাশে এক কলামের ছোট টাইপের শিরোনাম :’বাইরে সুনসান/ভেতরে গড়বড়’।
ছোট প্রতিবেদনটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এটি একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের অকুস্থল গাজীপুর থেকে পাঠানো প্রতিবেদন। তিনি যা লিখেছেন তার মূলকথা হলো, বাইরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকলেও ভেতরে বড় গড়বড় অনেক কেন্দ্রেই। বিএনপির পোলিং এজেন্ট নেই, যারা অনিয়ম ঠেকাতে তৎপর থাকেন। ওই সাংবাদিক নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা দু’একজনকে প্রশ্ন করে সদুত্তর পাননি। অন্যদিকে তিনি জনৈক প্রিসাইডিং অফিসারের উক্তি উদ্ৃব্দত করেছেন, যা হলো :’আপনাদের কেউ কাছাকাছি থাকলে এখানে পাঠান, বেশ চাপে আছি।’ এবার সাংবাদিক মহোদয়ের মন্তব্য, ‘ততক্ষণে ব্যালট পেপারে জবরদস্তি সিল মারার কারণে কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করার খবর অনলাইন সংবাদপত্র ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু কেন চাপ, কিসের চাপ, কাদের চাপ? ওই একই দৈনিকে প্রথম পাতায় আরেকটি শিরোনাম উল্লেখযোগ্য :’দিনভর বহিরাগতদের অবস্থান’। এখানে একটি তথ্য :’বুথের ভেতরেই নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী এক ব্যক্তি ভোটারের কাছে থাকা ব্যালট পেপারের মধ্যে শুধু মেয়র পদের ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে সিল দিয়ে বাক্সে ফেললেন।’ প্রশ্নের মুখে তিনি দ্রুত বাইরে চলে গেলেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এ জাতীয় ভোটদান কীভাবে সম্ভব, যদি কর্মকর্তাদের উদাসীনতা সেখানে কাজ না করে থাকে?
একটি ইংরেজি দৈনিকের (২৭.৬.২০১৮) শিরোনাম :Massive irregularities in GCC polls alleged. /BNP mayor candidate claims 400 out of 425 polling centers captured by AL activists./Voting was peaceful, AL mayor candidate.`
এ প্রতিবেদনের বিশদ বিবরণে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে এখানেও মূল খবর হলো, ভোট শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয়েছে। তবে কিছু অনিয়মতান্ত্রিক ঘটনা এর মধ্যেই ঘটেছে। কিন্তু বড় সমস্যা হলো, নির্বাচন কমিশনের নির্বিকারত্ব। তেমনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কারণ শেষোক্তরা ঠিকঠাকভাবে তৎপর থাকলে বহিরাগতরা ভেতরে ঢোকে কীভাবে এবং জবরদস্তির সিল মারাই-বা হয় কীভাবে? আরও একটি বড় প্রশ্ন পূর্বোক্ত প্রতিবেদনের সূত্রে :প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কেন অসহায়? কেন তাকে সাংবাদিক ডাকতে হয় তাকে সাহায্য করার জন্য? এর জবাব তো নির্বাচন কমিশন দিতে বাধ্য। তবে সংবাদপত্রে ভিন্ন রকম প্রতিবেদনও রয়েছে। যেমন একটি দৈনিকের প্রতিবেদনের শিরোনাম :’গাজীপুরে নৌকার জয়/ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভোট’। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ- ‘এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে।’ অন্য একটি দৈনিকের শিরোনাম :’বিচ্ছিন্ন অনিয়মে শান্তিপূর্ণ ভোট/ নৌকা ফিরল গাজীপুরে’ (বড় হরফে)। একটি দৈনিকের সম্পাদকীয়তে শিরোনাম :’গাজীপুর সিটি নির্বাচন/ বিজয়ীদের অভিনন্দন’।
সংবাদপত্রের এমন ধারার মিশ্র প্রতিবেদনের মমার্থ দাঁড়াচ্ছে, সংবাদপত্র মহলও সম্ভবত রাজনীতির দলীয় ধারায় বা নীতিগত বিচারের মতো প্রভাবিত। তবু কিছু বাস্তব তথ্য সবদিক থেকেই বেরিয়ে এসেছে। আর তা হলো, বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনার মধ্যেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ পর্ব শেষ। কিন্তু তা কীভাবে? সব দিক বিচারে আমাদের মনে হয়, গাজীপুর সিটি নির্বাচনও কিছু মাত্রায় খুলনাকে অনুসরণ করেছে বা তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। একটি দিক অবশ্য স্পষ্ট যে, অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট আসতে পারেনি বা থাকতে পারেনি, যে বিষয়টির পরোক্ষ স্বীকৃতি রয়েছে জনৈক নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তার বক্তব্যে।
নির্বাচনী প্রতিপক্ষের ঢালাও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ সঠিক না হলেও ভিন্ন কায়দায় বিপক্ষীয় পোলিং এজেন্টদের অনুপস্থিতির দিকটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং তা স্বাভাবিক নয়। তা হলে মানতে হয়, সব কেন্দ্রে ভোট পর্ব সুষ্ঠুভাবে ও অবাধে সম্পন্ন হয়নি। কিছুটা ভূতের কারসাজি এখানে রয়েছে। সংক্ষিপ্ত এ লেখা শেষ করি এমন চিন্তাভাবনায় যে, এবার গাজীপুরের পরিস্থিতি বিচারে বিজয়ীদের এতটা বেপরোয়া না হলেও হয়তো তারা বিজয় অর্জন করতে পারতেন। তবু নিশ্চিন্ত হতে গিয়ে দুর্নাম কিনতে হলো। আমাদের এ ধারণার প্রধান কারণ প্রার্থীদের ভোটসংখ্যার বিশাল ব্যবধান। একজন নিরপেক্ষ স্থানীয় ভোটদাতার মন্তব্যে একই যুক্তি উঠে এসেছে, সেই সঙ্গে বিজয়ী মেয়রের স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা। তার মতে, স্বাভাবিক নির্বাচনেও জাহাঙ্গীর আলম জয়ী হতেন বলে মনে হয়।
তবু একটি প্রশ্ন থেকে যায় পূর্বোক্ত টক শোর বক্তব্যে। তাদের মতে, সকালের প্রথমার্ধে ভোটার সংখ্যা ছিল অনেক। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের পুরো সময় পর্বে বিরল সংখ্যা, প্রায় সুনসান অবস্থা। মন্তব্য দু’একটি দৈনিকে। সে ক্ষেত্রে আমাদের একটি মাত্র প্রশ্ন :দ্বিতীয়ার্ধে ভোটার উপস্থিতি যদি এতই কম হবে, তাহলে প্রদত্ত ভোটসংখ্যা এত বিশাল হয় কীভাবে?
আনুষঙ্গিক প্রশ্ন :প্রথমার্ধে উপস্থিতির সংখ্যা এত বেশি হওয়ার পর হঠাৎ এতটা কমে গেল কেন? সেটা কি বিশেষ কোনো প্রভাবে? যাতে নির্বিবাদে সংখ্যা পূরণ চলে? এর সঠিক জবাব আমাদের জানা নেই। তবু প্রশ্ন থেকে যায় সুষ্ঠু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তবে খুলনা নির্বাচন উপলক্ষে লেখাটির কথা স্মরণ করে নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে আহ্বান- ‘আপনারা দায়িত্ব পালনে শতভাগ তৎপর হোন। পূর্ব উদাহরণ আপনাদের অনুপ্রাণিত করুক সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে। তা না হলে এমন ধারাই নির্বাচনী ধারা হয়ে দাঁড়াবে।
ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক।সুত্র-সমকাল