শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫, ০৭:৪০ অপরাহ্ন

যশোর জেলা জজসহ ৫ আদালত বিচারক শুন্য

ডি এইচ দিলসান, যশোর প্রতিনিধি:: যশোরের বিভিন্ন আদালতে বিচারক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজসহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি আদালতে বিচারক নেই। ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিয়ে চলছে মামলার কার্যক্রম। নতুন মামলা গ্রহণ, শুনানি ও নিষ্পত্তির হার কমে যাচ্ছে আর বাড়ছে মামলার জট। এ কারণে ভোগান্তির শেষ থাকছে না বিচারপ্রার্থী ও তাদের স্বজনদের। বর্তমানে এই পাঁচটি আদালতে ১৪৭৯৬ টি মামলার কার্যক্রম ঝুলে আছে।

বিভিন্ন সময় দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিন বিচারকশূন্য আদালতের পেশকাররা মামলার নথি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত বিচারকের টেবিলে যাচ্ছেন কিন্তু তাদের নিজ আদালতের ব্যস্ততায় তারিখ পরিবর্তন করা ছাড়া কিছু করার থাকছেনা। ফলে বিচারপ্রার্থীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। একদিকে যেমন ন্যায় বিচারের জন্য বাবারবার সময় নষ্ট করছেন, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারি কৌসুলি বলছেন, বিচারক চেয়ে বারবার আবেদন করা হলেও শুধু আশ্বাস মিলছে। তারপরও সংকট কাটছেনা। এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন তারা।

আদালত সূত্র জানায়, গত বছরের ২৪ নভেম্বর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইখতিয়ারুল ইসলাম মল্লিকের বদলির পর থেকে ভারপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে কাজ করছেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতের বিচারক কবির উদ্দিন প্রামানিক। এই আদালতে বর্তমানে ১ হাজার ৯৭৪ টি মামলা বিচারাধীন। গুরুত্বপূর্ণ এ আদালতে বিচারক না থাকায় দুর্ভোগের শেষ নেই বিচারপ্রার্থীদের। এ আদালতে পাবলিক সাক্ষী ও চার্জগঠন হচ্ছেনা। দেওয়ানী আপিল ও রিভিশন পেন্ডিং রয়েছে। রায়ও হচ্ছে না। ফলে, এ আদালতের সব মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকছেই।
গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি আদালত হচ্ছে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালত। এ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এটিই একমাত্র আদালত যেখানে সব ধরনের মামলার বিচার কাজ হয়ে থাকে। একইসাথে এই আদালতে সাকসেশন মামলা (কারো মৃত্যুর পর তার ব্যাংকে থাকা টাকা উঠানোর ক্ষেত্রে এ মামলা করা হয়) নিষ্পত্তি করা হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আদালতে বিচারক নেই সাড়ে তিন মাস। কবে আসবে সেটাও অনিশ্চিত। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর আসিফ ইকবালের বদলির পর যুগ্ম দায়রা জজ অতিরিক্ত আদালতের বিচারক খাইরুল ইসলাম এই আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমানে এ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ২৩৪। এই আদালতে রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে শতাধিক মামলা। নিয়মিত বিচারক না থাকায় বারবার তারিখ পরিবর্তন হচ্ছে। যুগ্ম দায়রা জজ অতিরিক্ত আদালতেই রয়েছে পাহাড় সমান মামলা। ফলে, নিজের আদালতে মামলা রেখে ভারপ্রাপ্ত আদালতের মামলা পরিচালনা করতে প্রচন্ড বেগ পেতে হচ্ছে। তবে, এ আদালতে নিয়মিত বিচারক নিয়োগের বিষয়ে আইনজীবীরা সমিতির কাছে দাবি জানালেও তার কোনো পক্ষক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন আইনজীবী।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আদালত হচ্ছে সদর সিনিয়র সহকারী জজ। যশোরের আটটি থানার জন্য একটি করে সিনিয়র সহকারী জজ আদালত থাকলেও সদরের আদালতে মামলা রয়েছে অন্য আদালতের তুলনায় দ্বিগুণ। বর্তমানে এ আদালতে ৪ হাজার ৪২৫ টি মামলা রয়েছে। অথচ বিচারক নেই প্রায় দু’ মাস। গত বছরের ১৭ নভেম্বর তৎকালীন বিচারক পদোন্নতিজনিত কারণে গোপালগঞ্জে বদলির পর থেকে বিচারক আসেননি। ঝিকরগাছার সহকারী জজ আদালতের বিচারক সুজাতা আমিন ভারপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অভয়নগর সহকারী জজ আদালতে নির্ধারিত বিচারক নেই এক বছরের বেশি সময় ধরে। ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর বিচারক সুমনা পালের বদলির পর এ আদালতের ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পান রেজাউল করীম বাধন। এরপর তিনিও বদলি হয়ে যান। তখন থেকে মণিরামপুর সহকারী জজ আদালতের বিচারক বিলাস মন্ডল এ আদালতের দায়িত্বপালন করছেন। বর্তমানে এই আদালতে ২ হাজার ৩৬৪ টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

একইভাবে বাঘারপাড়া সহকারী জজ আদালতেও বিচারক নেই। ২০২২ সালের ৩০ মার্চ সালমান আহমেদ শুভর বদলির পর বর্তমানে এ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারকের দায়িত্বে রয়েছেন কেশবপুর সহকারী জজ আদালতের বিচারক শারমীন নাহার। এই আদালতে বর্তমানে ১ হাজার ৭৯৯টি মামলা বিচারাধীন। বিচারক সংকটের কারণে রোববার বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় যশোরের ব্যবসায়ীদের। এদিন চেম্বার অব কমার্সের নির্বাচন সংক্রান্ত একটি মামলায় ১৮ জন ব্যবসায়ী আসেন সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে। নিয়ম অনুযায়ী তারা সদর সহকারী জজ আদালতের সামনে উপস্থিত হন। তখন এজলাসের সামনে সাংবাদিকরাও অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু পরে জানা যায় সদর সহকারী জজ আদালতে বিচারক না থাকায় এ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঝিকরগাছা সহকারী জজ আদালতের বিচারক। জানা যায় ঝিকরগাছার এজলাসে সদরের বিচার কাজ হবে। তখন ব্যবসায়ীদের ঝিকরগাছা আদালতে ছুটতে হয়। নির্ধারিত বিচারক থাকলে এ ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হতোনা বলে অনেকেই মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে কথা হয় বিচারপ্রার্থী শরিফুল আলম খানের সাথে। তিনি বলেন, যশোরের একটি আদালতে তার বিরুদ্ধে একটি চেকের মামলা রয়েছে। যা আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এখন শুধু রায়ের অপেক্ষা। বিচারক না থাকায় তিনি খালাস পাচ্ছেন না। এতে করে তার বিদেশ যাওয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আরেক বিচারপ্রার্থী অভয়নগরের মনিরুল ইসলাম বলেন, একটি দেওয়ানি মামলায় একবছরের বেশি সময় আদালতে যাতায়াত করছেন। কিন্তু বিচারক না থাকায় বেগ পেতে হচ্ছে তার। এক বছরে আইনজীবীদের টাকা দেয়া ও যাতায়াত খরচসহ অন্তত ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

এদিকে, এক আদালতে বিচারক না থাকায় যেমন ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে, অন্যদিকে এক বিচারকের দু’টি আদালতের দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে করে বিচারপ্রার্থীরা যেমন সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে বাড়তি চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে বিচারকদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বেঞ্চ সহকারী বলেন, তার আদালতের বিচারককে দু’টি আদালতের দায়িত্বপালন করতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপ নিতে হচ্ছে। এতে করে তার নিজের আদালতের মামলায় বেশি সময় দিতে পারছেন না। ফলে, দু’টি আদালতের কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারাও দ্রুত বিচারক নিয়োগের দাবি জানান। এ বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফরিদুল ইসলাম বলেন, ভারপ্রাপ্ত বিচারক কখনই অন্য কোনো আদালতের মামলা দায়িত্ব নিয়ে করতে পারেন না। সেখানে সাক্ষী হয় না, শুনানি হয় না।

এ বিষয়ে অন্তত আট-নয়জন সিনিয়র আইনজীবীর সাথে কথা বললে তারা বলেন, আদালতগুলোয় নির্দিষ্ট বিচারক না থাকায় স্থবির হয়ে পড়ে আছে প্রতিটি মামলা। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত মক্কেলদের সাথে গোলোযোগ বাধতে থাকে। মামলার দিন পরিবর্তন হওয়ায় তারা আইনজীবীদের দায়ী করেন। যা নিয়ে তারা বিব্রত। তারা দ্রুত নিয়মিত বিচারক নিয়োগের দাবি জানান।

জেলা জজ আদালতের পিপি এম.ইদ্রিস আলী বলেন, জেলা জজসহ অন্য আদালতে বিচারক না থাকায় সমস্যা হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত বিচারকদের হাতে সবধরনের পাওয়ার থাকেনা। আপিল রিভিশনে ঘাটতি থাকে। তিনি নিজে ঢাকায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছেন। দ্রুতই এ বিষয়ে সমাধান হবে বলে জানান ইদ্রিস আলী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com