বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫, ০৭:৪৫ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : ইতিহাসের হাতছানি, আনহেল দি মারিয়ার বিদায়—কলম্বিয়ার বিপক্ষে কোপা আমেরিকার ফাইনাল ঘিরে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের আবেগের পারদ ম্যাচের আগে থেকেই চড়ে ছিল । সেই আবেগ যেন শতধারায় উৎসারিত হতে শুরু করে চোট পেয়ে লিওনেল মেসিকে মাঠের বাইরে চলে যেতে হলে । মাঠ ছাড়তে ছাড়তে কেঁদেছেন মেসি। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক কেঁদেছেন ডাগআউটে বসেও ।
টেলিভিশনের পর্দায় মেসির কান্নার দৃশ্য দেখতে দেখতেই ম্যাচের নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয়েছে গোলশূন্য অবস্থায়, ম্যাচ গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে । সেখানে বদলি হিসেবে নামা লাওতারো মার্তিনেজের ১১২ মিনিটের গোলে চরম আবেগের ম্যাচে কলম্বিয়াকে ১–০ ব্যবধানে হারিয়ে কোপা আমেরিকার রেকর্ড ১৬তম শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা । এর আগে ১৫টি শিরোপা জিতে উরুগুয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কোপা আমেরিকার সর্বোচ্চ শিরোপা জয়ের রেকর্ডে নাম ছিল তাদের ।
এই জয়ে একটি ত্রিমুকুটও পেয়ে গেলেন মেসি–দি মারিয়ারা। মহাদেশীয় শিরোপা, বিশ্বকাপ, আবার মহাদেশীয় শিরোপা-স্পেনের পর এই ত্রিমুকুট জেতা দ্বিতীয় দল এখন আর্জেন্টিনা । ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার পর ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনা জিতল ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকা । স্পেন এই কীর্তি গড়েছিল ২০১০ বিশ্বকাপের আগে ও পরে ইউরোর শিরোপা জিতে। ইউরোর শিরোপা দুটি তারা জিতেছে ২০০৮ ও ২০১২ সালে ।
আর্জেন্টাইনদের আবেগের ম্যাচটি দর্শক–বিশৃঙ্খলার কারণে প্রায় ১ ঘণ্টা ২২ মিনিট দেরিতে হয় । বিনা টিকিটে খেলা দেখতে আসা কিছু দর্শক নিরাপত্তর বেড়াজাল এগিয়ে মাঠে ঢোকার চেষ্টা করে । সেটা সামলাতে সময় লাগায়ই ম্যাচ শুরু করতে এই দেরি ।
দেরিতে শুরু হওয়া ম্যাচে প্রথম আক্রমণটা করেছিল আর্জেন্টিনা । কিন্তু এরপর থেকেই ম্যাচে শুরু হয় কলম্বিয়ার আধিপত্য। পুরো প্রথমার্ধেই আর্জেন্টিনার ওপরে ছড়ি ঘুরিয়েছেন হামেস রদ্রিগেজ-লুইস দিয়াজরা । প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার চেয়ে সবদিক থেকেই এগিয়ে ছিল কলম্বিয়া । প্রথমার্ধ শেষে কলম্বিয়ার বলের দখল ছিল ৫৩ শতাংশ, আর্জেন্টিনার ৪৭ শতাংশ । কলম্বিয়া গোলে শট নিয়ে লক্ষ্যে রেখেছে ৪টি, আর্জেন্টিনা ১টি । কলম্বিয়ার মোট পাস ২৫৭টি, আর্জেন্টিনা ২৩২টি । নিখুঁত পাসেও এগিয়ে ছিল কলম্বিয়া-৯০ শতাংশ, আর্জেন্টিনা ৮৭ শতাংশ ।
প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনাকে কোণঠাসা করে রাখা কলম্বিয়া ম্যাচে প্রথম সুযোগ পায় ৫ মিনিটে। বাঁ প্রান্ত দিয়ে বক্সের বাইরে থেকে লুইস দিয়াজের গড়ানো শট এমিলিয়ানো মার্তিনেজ সহজেই গ্লাভসে নেন । পরের মিনিটেই ডান প্রান্ত থেকে হামেস রদ্রিগেজের ছোট ক্রস থেকে বক্সের মধ্য থেকে ভলি করেন করদোবা, কিন্তু বল দূরের পোস্টে লেগে চলে যায় বাইরে । ১১ মিনিটে ম্যাচের দ্বিতীয় ও কলম্বিয়ার প্রথম কর্নার । ১২ মিনিটে রদ্রিগেজের কর্নার থেকে প্রথমে হেড করে বল বক্সের ঠিক মাঝে দেন দিয়াজ । সেখান থেকে করদোবার হেড গোললাইন থেকে ঠেকান মার্তিনেজ ।
ম্যাচ ১০ মিনিট পেরোনোর পর পজিশন বদলে বাঁ উইংয়ে চলে যান দি মারিয়া । এরপর বাড়ে আর্জেন্টিনার আক্রমণের গতি । দি মারিয়া জায়গা বদলের পর কিছুক্ষণ ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ছিল আর্জেন্টিনার কাছে । সেই সময়ই প্রথমার্ধে লক্ষ্যে রাখতে পারা একমাত্র শটটি নেন মেসি । ১৯ মিনিটে দি মারিয়ার দুর্দান্ত এক নিচু ক্রস থেকে বক্সের মধ্যে বল পান আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। প্রথম স্পর্শটাই ছিল গোলমুখী তীব্র গতির শট । কিন্তু আর্জেন্টিনারই এক খেলোয়াড়ের পায়ে লেগে বলের গতি কমে যায়। কলম্বিয়ার গোলকিপার ভারহাস সহজেই বল গ্লাভসে নেন ।
আর্জেন্টিনার মিনিট বিশেকের আধিপত্যের পর আবার ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় কলম্বিয়া । ৩২ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে কলম্বিয়ার লেমার বুলেট গতির শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে কোনোমতে হাতে লাগিয়ে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন মার্তিনেজ । ২৬ মিনিটে হালকা চোট পান মেসি । ক্রস করতে গিয়ে তাঁর পায়ে পা লাগে কলম্বিয়ান ডিফেন্ডারের । মাঠের বাইরেও চলে যেতে হয়েছিল । তবে একটু পরই মাঠে ফেরেন তিনি । ৪২ মিনিটে বক্সের ঠিক বাইরে ফ্রি-কিক পায় আর্জেন্টিনা । মেসির ফ্রি-কিক থেকে তালিয়াফিকোর হেড চলে যায় বারের ওপর দিয়ে ।
৪৮ মিনিটে বক্সের বাঁ প্রান্ত থেকে আসা মেসির পাস আরেকজনের পা হয়ে ফাঁকায় এসে বক্সের মধ্যে পড়ে । কিন্তু তালিয়াফিকো শট নেওয়ার আগেই সেটা কলম্বিয়ার গোলকিপার স্লাইড করে দূরে পাঠান । বল পেয়ে যান দি মারিয়া । তাঁর নেওয়া শট দ্রুত জায়গায় এসে ফিরিয়ে দেন গোলকিপার । ৫৬ মিনিটে দি মারিয়ার ক্রসে ম্যাক অ্যালিস্টারের হেড ঠেকিয়ে কলম্বিয়ার এক খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে ফিরে আসে । সেখান থেকে বল পেয়ে যান মেসি । তিনি আবার বল পাঠান বক্সে । কিন্তু এবার আর বল পাননি আর্জেন্টিনার কেউ । ৫৭ মিনিটে আবার দি মারিয়া বল নিয়ে বক্সে ঢুকে পাস দেওয়ার ভান করে গোলে শট নেন । সেটি কর্নারের বিনিময়ে কোনোমতে রক্ষা করেন গোলকিপার ।
৬৩ মিনিটে দিয়াজের কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে গিয়ে পেশিতে টান লাগে মেসির । মাঠে পড়ে যান তিনি । মাঠে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার কিছুক্ষণ পর বাইরে চলে যান আর্জেন্টিনার অধিনায়ক । তাঁর জায়গায় আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি মাঠে নামান নিকোলাস গঞ্জালেসকে । মাঠ ছাড়ার সময় হতাশায় বারবার মুখ ঢাকছিলেন মেসি । গ্যালারিতে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের চোখেমুখেও ছিল একই রকম হতাশা । একটু পর মেসি ডাগআউটে বসে কেঁদেওছেন ।
পরের মিনিটেই করদোবার ট্যাকলে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান গঞ্জালো মনতিয়েল, তাঁর জায়গায় মাঠে নামেন নাহুয়েল মলিনা । এরপরই দারুণ এক সুযোগ পেয়ে যায় কলম্বিয়া । কিন্তু সেটি কাজে লাগাতে পারেনি তারা । উল্টো করদোবা ফাউল করেন ম্যাক অ্যালিস্টারকে । কিন্তু পায়ে ব্যথা পান করদোবাও । এ কারণে সম্ভাব্য পেনাল্টি চেক করেন রেফারি। পরে অবশ্য আর্জেন্টিনাকেই ফাউল দেন রেফারি ।
মেসি–দি মারিয়ারা আনন্দ–বেদনার কান্না যখন মাখামাখি, মাঠে ছড়িয়ে পড়ে তুমুল উত্তেজনা । পিছিয়ে পড় কলম্বিয়ার খেলোয়াড়েরা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না সম্ভাব্য হার। একটা পর্যায়ে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা ।
সেই ফ্রিক-কিক থেকে কলম্বিয়ার বক্সের ঠিক বাইরে বল পেয়ে যান দি মারিয়া । তিনি বক্সের মধ্যে বল বাড়ান তালিয়াফিকোকে । তিনি বল দেন নিকো গঞ্জালেসকে, বল তিনি জালেও জড়ান । কিন্তু এর আগেই সহকারি রেফারি অফসাইডের জন্য পতাকা তোলেন । পরে ভিএআরেও দেখা গেছে তালিয়াফিকো ছিলেন অফসাইডে । এর পরের মিনিটেই নিকো গঞ্জালেসের শট পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে বল চলে যায় ।
এরপর আরও দুটি সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি আর্জেন্টিনা । ৮৭ মিনিটে বক্সের মধ্যে গোলকিপারকে একা পেয়ে গোল করতে পারেননি দি মারিয়া । আর যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে দি মারিয়ার ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে পারলেই গোল পেতেন নিকো গঞ্জালেস । কিন্তু তিনি পারেননি । ম্যাচ শেষ পর্যন্ত গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে ।
আর্জেন্টিনার অধিনায়কের জায়গায় মাঠে নামা নিকো গঞ্জালেস বল জালে জড়ালেও অফসাইডের কারণে গোল বাতিল করেন রেফারি । নির্ধারিত ৯০ মিনিটে গোলশূন্য থাকা ম্যাচ গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে । সেখানে ৯৪ মিনিটে রদ্রিগো দি পলের ক্রসে শট না নিয়ে ডামি করেন দি মারিয়া । বল পেয়ে যান তাঁর পেছনে থাকা নিকো গঞ্জালেস, গোললাইন থেকে সেটি বাঁচিয়েছেন ভারহাস । ১০১ মিনিটে আবার দুর্দান্ত এক আক্রমণ থেকে গোল পায়নি কলম্বিয়া । ১০৭ মিনিটে দি মারিয়ার ক্রসে পা লাগাতে পারলেই গোল পেতেন হুয়ান আলভারেজের জায়গায় ৯৭ মিনিটে মাঠে নামা লাওতারো মার্তিনেজ । কিন্তু তিনি তা পারেননি ।
১১২ মিনিটে বাঁ প্রান্ত থেকে রদ্রিগো দি পলের পাস মাঝমাঠে খুঁজে নেয় জিওভান্নি লো সেলসোকে । তিনি বল বাড়ান ডান প্রান্তে বক্সের কাছাকাছি থাকা মার্তিনেজকে । ঠাণ্ডা মাথায় বল জালে জড়ান ইন্টার মিলানের ফরোয়ার্ড । এ নিয়ে এবারের কোপা আমেরিকায় তাঁর গোল হলো ৫টি । সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটা উঠছে তাঁরই হাতে । মেসি মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার পর ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে নেতৃত্ব পেয়েছিলেন দি মারিয়া । কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার তাঁকে তুলে কোচ লিওনেল স্কালোনি মাঠে নামান ডিফেন্ডার নিকোলাস ওতামেন্দিকে ।
দি মারিয়া মাঠ থেকে নেমে ডাগআউটে গিয়ে কান্নাভেজা চোখে জড়িয়ে ধরেন মেসিকে । মেসিও কাঁদলেন দি মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে । ১৬ বছরের সতীর্থকে বিদায় দেওয়ার কষ্টের সঙ্গে মেসির এবারের কান্নায় মিশে ছিল কিছুক্ষণ পরই কোপা আমেরিকার শিরোপা জিততে যাওয়ার আনন্দও ।
মেসি–দি মারিয়ারা আনন্দ–বেদনার কান্না যখন মাখামাখি, মাঠে ছড়িয়ে পড়ে তুমুল উত্তেজনা । পিছিয়ে পড় কলম্বিয়ার খেলোয়াড়েরা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিলেন না সম্ভাব্য হার। একটা পর্যায়ে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা । রেফারি মধ্যস্থতায় থামে সে মারামারি । এরপর…? মেসি–দি মারিয়াদের ইতিহাস, আর্জেন্টাইনদের আনন্দে মেতে ওঠা!