বুধবার, ৩০ Jul ২০২৫, ০৫:৪৮ অপরাহ্ন
আবুল বাশার শেখ, ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি:: ময়মনসিংহের ভালুকায় আধুনিকতার উৎকর্ষতায় আর শিল্পায়নের প্রভাবে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা শান্তির নীড় মাটির ঘর এখন বিলুপ্তির পথে। এক সময় গ্রামের মানুষের কাছে গরীবের এসি বাড়ি বলে বিবেচিত ও পরিচিত মাটির ঘর কালের বিবর্তনে বর্তমানে খুব কমই চোখে পড়ে।
আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেও। মাটির ঘরের জায়গায় তৈরি হচ্ছে প্রাসাদসম অট্টালিকা। মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইট-পাথরের দালান। একটু সুখের আশায় মানুষ কত কিছুই না করছে। তবুও মাটির ঘরের শান্তি ইট পাথরের দালান কোঠায় খুঁজে পাওয়া ভার। শীত ও গরম উভয় মৌসুমে আরামদায়ক মাটির ঘর প্রাচীনকাল থেকে গ্রাম বাংলায় প্রচলন ছিল। এঁটেল মাটি দিয়ে এসব ঘর তৈরী করা হয়। মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে কাঁদায় পরিণত করে সেই কাঁদা ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া করে দেয়াল তৈরী করা হয়। এ দেয়াল তৈরি করতে বেশ সময় লাগে কারণ একসাথে বেশি উঁচু করে তৈরি করা যায় না। প্রতিবার এক দেড় ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করা হয়। কয়েকদিন পর শুকিয়ে গেলে আবার তার উপর একই উচ্চতার দেয়াল তৈরি করা হয়। এভাবে দেয়াল ১০-১২ ফুট উঁচু হলে কিছুদিন রোদে শুকানো হয়। তারপর এই দেয়ালের ওপর কাঠ কিংবা বাঁশের চাল তৈরি করে খড় বা টিন দিয়ে ছাউনি দেয়া হয়। একটি মাটির ঘর তৈরি করতে প্রায় দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লাগে। মাটির ঘর শীত গরম উভয় মৌসুমে বেশ আরামদায়ক। তবে বন্যা, ভূমিকম্প বা প্রবল ঝড় না হলে এসব ঘর শত বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। অনেক সময় মাটির ঘর দোতলা পর্যন্ত করা হয়। এ সমস্ত ঘর বেশি বড় হয়না। গৃহিনীরা তাদের নরম হাতের কোমল ছোঁয়ায় নিপুনভাবে কাঁদা মাটি দিয়ে লেপে মাটির ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এখন আর সেই মাটির ঘর খুব বেশি চোখে পড়ে না বললেই চলে। তবে এখনো বাপ-দাদার স্মৃতি ধরে রাখতে অনেকেই খরচ করে দু’একটা মাটির ঘর টিকিয়ে রেখেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, হবিরবাড়ী ইউনিয়নের বিশিষ্ট শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়ার আলী হোসেন তার মনোরম অট্টালিকার ভেতরে বাবার স্মৃতি হিসেবে একটি মাটির ঘরকে ষ্টিলের সমন্বয়ে মজবুত করে বিশেষ ব্যবস্থায় আগলে রেখেছেন। যা যে কোন মানুষকে মুগ্ধ করে। এ বিষয়ে তিনি জানান, ১৯৮৭ সালে আমি এই মাটির ঘরটি তৈরি করেছিলাম। কালের সাক্ষী হিসেবে মাটির ঘরের পাশে দালান ঘর তৈরি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্ম সংরক্ষণ করে রেখেছি। আমি এই মাটির ঘরে বসবাস করে আরাম অনুভব করি। প্রচন্ড তাপদাহে বাড়ির লোকজন শান্তির পরশ হিসেবে আমার এই মাটির ঘরকে বেঁছে নেয়। বর্তমানে মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিয়েছে ইট, সিমেন্ট, বালি ও রডের তৈরি পাকা ঘরগুলো।
মাটির ঘরগুলো বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ ক্ষতি সাধন হয় বলেই মানুষ ইট সিমেন্টের ঘর-বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছে। তাছাড়া গ্রামের মানুষ আগের তুলনায় এখন অনেক আধুনিক। প্রতি বছর মাটির ঘরে খরচ না করে একবারে বেশি খরচ হলেও পাকা ঘর-বাড়িই নির্মাণ করছে।
ধীতপুর ইউনিয়নের বাদে পুরুড়া গ্রামের হিমেল পাঠান জানান, মাটির ঘর বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও যুগের বিবর্তনে অধিকাংশ মানুষ মাটির ঘর ভেঙে অধিক নিরাপত্তা ও স্বল্প স্থানে অধিক লোকের বসবাসের জন্য পাকা ঘরকে পছন্দের তালিকায় নিয়ে আসছে।
বর্তমানে মাটির ঘরের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কাছাকাছিতে ঠেকেছে। ভালুকার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে এখনো কিছু মাটির ঘর চোখে পড়ে। এর মধ্যে উথুরা, ভরাডোবা, ধীতপুর, কাচিনা, ডাকাতিয়া, রাজৈ, হবিরবাড়ী উল্লেখ্যযোগ্য। হয়তো সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন মাটির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাবে, আগামী প্রজন্মের মানুষের কাছে মাটির ঘর রূপকথার গল্পের মত মনে হবে।