সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:১০ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, একুশের কণ্ঠ:: বাংলাদেশের ইতিহাস আত্মত্যাগের, প্রতিরোধের এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর এক দীর্ঘ সাহসী অভিযাত্রা। এই অভিযাত্রার প্রতিটি বাঁকে বাংলাদেশি জাতি যখনই অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকির মুখে পড়েছে, গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হয়েছে কিংবা মানুষ নিঃশ্বাস ফেলার স্বাধীনতাটুকুও হারিয়েছে; তখন বারবার একটি নাম সামনে এসেছে- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী অগ্রযাত্রায় বারবার অগ্রণী ভূমিকা রাখা বিএনপির আজ ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়া দলটি আজ গৌরব ও আত্মত্যাগে সমুজ্জ্বল এক নাম।
১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তখনকার আওয়ামী লীগের সরকার দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। এরপর অনেক রক্তক্ষয়ী ঘটনার সাক্ষী হয়েছে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশ। এক অরাজক ও অনিশ্চিত ভবিতব্য যখন চোখ রাঙাচ্ছিল, তখন সিপাহী-জনতার বিপ্লব সামনে নিয়ে আসে এক মহানায়ককে, যিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন ত্রাণকর্তা হয়ে।
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনার বটমূল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। দেশকে সমৃদ্ধ ও মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে নেয়া নানা কর্মসূচির কারণে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিএনপি। জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল সমৃদ্ধ দেশ গঠনে যুগান্তকারী সনদ।
দেশ যখন উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য হত্যা করে জয়িাউর রহমানকে। আবার এক মহাশূন্যতায় যখন দেশ, তখন রাজনীতিতে আগমন ঘটে তার সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিএনপি ফিরে পায় নতুন দিশা। রাজপথে তার আপোষহীন নেতৃত্ব স্বৈরাচার এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করে।
শহীদ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর খালেদা জিয়ার দূরদর্শী বিভিন্ন কর্মসূচি তাকে দেশবাসীর কাছে দ্রুতই জনপ্রিয় করে তোলে। তার আপোষহীন নেতৃত্বে ৯ বছর পর জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সাল রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পায় বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর আরও দুই দফা তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
পরবর্তীতে কর্তৃত্বপরায়ণ আওয়ামী লিগ সরকারের আমলে দুর্নীতির কথিত মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালে কারাগারে নেয়া হলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে হাল ধরেন তারেক রহমান। দলকে সুসংগঠিত করা, আন্দোলনে গতি আনা এবং রাজনীতিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করাসহ নুতন নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি এগিয়ে নিচ্ছেন দলকে।
দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণের অধিকার আদায়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাসহ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবারও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য।’
তারেক রহমান বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে জনগণকে একত্রিত করার লক্ষ্যে মহান স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দিনটি বাংলাদেশি মানুষদের জন্য আনন্দ, উদ্দীপনা ও প্রেরণার। দলটি বাংলাদেশি ভূখণ্ডের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেয়ার নীতিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
প্রায় ৫ দশকের পথচলা বিএনপির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে, গত ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক নয়া সমীকরণ। তাই গতানুগতিক রাজনীতি থেকে এবার বেরিয়ে আসতে চাইছে দলটি। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ৩১ দফা সংস্কার রূপরেখা ঘোষণা করেছেন তারেক রহমান।
দলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাসসকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক শূন্যতা অনুভব করেই বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি শুধু বহুমত গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং বাংলাদেশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে গেছে। ‘
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। আজ আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, যেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ আজ বিএনপির দিকেই তাকিয়ে আছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এর কারণ হল- বিএনপিই একমাত্র দল যারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম। তাই আজকে আমরা শপথ নিয়েছি যে কোনো বাধাই আসুক, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠাতা করা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করে যাবো। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে গণতন্ত্রকামী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবো।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আজ দলের ৪৭ বছরে এসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন। গণমানুষের দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন।’
বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত আছে উল্লেখ করে ড. মোশাররফ আরও বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও সংগ্রামের চূড়ান্ত অর্জন হলো চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। এই বিপ্লবের চেতনায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীতে দেশ পুনর্গঠনে সকলে একসঙ্গে কাজ করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে দলটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সেই দলটিই আজ আবার গণতন্ত্রের নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এগিয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের জন্য আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। অদূর ভবিষ্যতে এটি হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে থাকবে না ক্ষমতার দম্ভ অথবা আস্ফালন। এ মহান আদর্শে বিশ্বাসী হয়েই বিএনপি জনগণের জন্য রাজনীতি করে যাবে।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, ‘আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে বিএনপি অতীতের ভুলভ্রান্তি দূর করে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী দিনে বিএনপিকে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হতে হবে। বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফা রূপরেখা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। দেশ পরিচালনায় তাদের অঙ্গীকারগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায়, ভবিষ্যতে ফের চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে দলটি।
বিএনপির আগামী দিনের পথচলা কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘দিন বদলেছে, বদলেছে প্রেক্ষাপটও। তাই বিএনপি বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তাদের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা ক্ষমতায় গেলে কতটুকু বাস্তবায়ন করবে সেদিকে তাকিয়ে আছে জনগণ। তবে রাজনীতির এই বিশ্লেষক মনে করেন, জনআস্থা পেতে হলে বিএনপিকে দলে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা বুঝে কাজ করতে হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে পথ চলতে হবে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। গতকাল ৩১ আগস্ট রাজধানীর রমনাস্থ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আজ ১ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় বিএনপির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সকাল ১১টায় মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর সমাধিতে বিএনপি মহাসচিবসহ দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। কাল দেশব্যাপী জেলা ও মহানগরে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে। ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা ও পৌরসভায় আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হবে। সুবিধাজনক সময়ে ঢাকাসহ দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৃক্ষরোপণ অভিযান, মৎস্য অবমুক্তকরণ, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও ক্রীড়ানুষ্ঠানের কর্মসূচি রয়েছে দলটির।