বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫, ১২:৫০ পূর্বাহ্ন
দিনাজপুর প্রতিনিধি ॥ নবান্নের বদলে ধানের জেলা দিনাজপুরের কৃষকের ঘরে ঘরে এখন চাপা কান্না ও উৎকণ্ঠা। ‘পাকা ধানে মই’ বাংলা এ প্রবাদটি এখানে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। কয়েক দিন ঘন ঘন ভারি বৃষ্টিপাতে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দেখা গেছে, কোথাও পাকা ধান নুয়ে পড়েছে, আবার কোথাও আধা পাকা ধান কেটে নিচ্ছেন কৃষকরা। এ পরিস্থিতির সাথে যোগ হয়েছে শ্রমিক সঙ্কট। যদিও শ্রমিক পাওয়া যায়, তাদের দিতে হয় উচ্চ মূল্য। এতে জমির অর্ধেক ধান শ্রমিকদের মজুরি দিতেই চলে যাচ্ছে। সার্বিক অবস্থায় এ অঞ্চলের কৃষকরা এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
দিনাজপুর সদর, চিরিরবন্দর ও পার্বতীপুর উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে টানা ভারি বৃষ্টি আর বাতাসে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা পাকা ধান মাটিতে পড়ে ও পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও ধান কেটে বেঁধে জমিতে রাখার পর এখন বৃষ্টির পানিতে ভাসছে। অনেকে আবার আধা পাকা ধান এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কেটে ফেলছেন। এতে ফলন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বলে জানান কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, গত মৌসুমে ইরি-বোরো বিঘা প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ মণ করে হলেও এবার বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ মণ ফলন হয়েছে। এদিকে শ্রমিক সঙ্কটে দিশাহারা কৃষক। জমির অর্ধেক ধান শ্রমিকদের মজুরি দিতেই চলে যাচ্ছে। তবু সময়মতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তারা।
সদর উপজেলার মোহনপুর এলাকার কৃষক ইয়াসিন আলী বলেন, আট বিঘা জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছি। পাঁচ বিঘা কাটছি হারভেস্টার মেশিন দিয়ে। বাকি জমির ধান কাটতে পারি নাই। ঝড়-বৃষ্টিতে ধান মাটিতে পড়ে গেছে। এখন তো শ্রমিক পাওয়াই যাচ্ছে না। বাইরের উপজেলা থেকে ধান কাটা শ্রমিক এনেছি। ১০ হাজার টাকা বিঘা দাম দিয়ে পড়া ধান কাটতে লাগিয়ে দিয়েছি। তবু ধান কাটতে চান না শ্রমিকরা। জমির অর্ধেক ধান শ্রমিকদের মজুরি দিতেই চলে যাচ্ছে। এবার খুব লসের মুখে পড়েছি।
একই গ্রামের কৃষক ফজর আলী বলেন, ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে তড়িঘড়ি করে কিছু জমির ধান কেটে ঘরে তুলেছি। গত দুই রাতের বৃষ্টি আর বাতাসে আমার চার বিঘা জমির পাকা ধান মাটিতে পড়ে গেছে। এখন দ্বিগুণ দাম দিয়ে এ ধান কাটাতে হবে। তাও মিলছে না শ্রমিক। কারণ, মাটিতে পড়া ধান কাটতে চান না শ্রমিকরা। আবার পাওয়া গেলেও বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা চাচ্ছে। উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে বেশি দামে কাটাচ্ছি। এমনিতে বাজারে ধানের দাম কম। কষ্ট করে ধান ফলিয়ে যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে।
চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক ফরিদুল ইসলাম বলেন, আমার পাঁচ বিঘা জমির পাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন ধান কাটব কী করে? ধান মাটিতে পড়ে যাওয়ায় হারভেস্টার মেশিন দিয়ে কাটা সম্ভব নয়। জমির পানি শুকালে তখন কাটাতে হবে শ্রমিক দিয়ে। পড়ে যাওয়া ধান কাটতে খরচ বেড়ে যাবে আবার সময়মতো ধান কাটতে না পারলে জমিতে ধান পচে যেতে পারে।
দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, জেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক লাখ ৭৪ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে সাত লাখ ২৯ হাজার ২৬৩ টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক লাখ ৭১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় সাত লাখ ৩১ হাজার ১৭৩ টন এবং ২০২০-২১ মৌসুমে এক লাখ ৭১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে সাত লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) খালেদুর রহমান বলেন, বৃষ্টিতে ধানের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ তেমন একটা নেই। কিছু জায়গায় ধানের জমিতে পানি আটকে গেলেও আমরা কৃষকদের পানি বের করার জন্য বলেছি। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। পানি লেগে থাকা ধান কৃষকরা কেটে নিচ্ছেন। আশা করছি তেমন ক্ষতি হবে না।
জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, দখিনা বাতাসের সাথে পশ্চিমা লঘু চাপের সংমিশ্রণের কারণে আকাশে প্রচুর মেঘমালার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি হিমালয় পর্বতমালায় বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ছড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য আকাশ সব সময় মেঘলা থাকছে। আগামী পাঁচ থেকে সাত দিন এ ধরনের আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে।