মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:১১ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধিঃ রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়াভাব যেন কমছেই না। গাংচিল, ঘুটা দে, চেতাইলেই ভেজাল আছে, লাড়া-দে, চিনে-ল, কোপাই-দে, দ্যা কিং অব গাইরালা, অনলি কোপাইয়া দে ইত্যাদি বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে এসব কিশোর গ্যাং। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, আমিনবাজার, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, বংশাল, চকবাজার, কোতোয়ালি, ওয়ারীসহ এসব থানা এলাকায় এতটাই বেপরোয়া কিশোর গ্যাং যেখানে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৯টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলার আসামিদের নিহতের পরিবারকে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। মামলা শেষে কারাগার থেকে বেরিয়ে পুনরায় তারা একই ধরনের অপরাধে যুক্ত হচ্ছেন বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুনের পাশাপাশি যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং চাঁদাবাজি-দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কাজ সংঘঠিত করছে। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে রিকশা-অটোরিকশায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে সন্ত্রাসী গ্রুপ ‘কবির বাহিনীর’ মূলহোতা কবিরসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
চক্রটি রাস্তা ও অলিগলিতে ছিনতাই থেকে শুরু করে তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা নদীতে মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে ডাকাতি করতো।
রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে কবির। এর আগে গত ৩০ নভেম্বর রাতে মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং এলাকায় রিকশা-অটোরিকশা যাত্রীদের কাছ থেকে ব্যাগসহ মালামাল ছিনিয়ে নেয় চক্রের কয়েক সদস্য। ঘটনার প্রায় এক মাস পর গত সপ্তাহে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১০ সালে ‘গাংচিল’ নামে একটি সন্ত্রাসী বাহিনীতে যোগ দিয়ে অপরাধ জগতে হাতেখড়ি কবির বাহিনীর। বখে যাওয়া তরুণদের নিজের বাহিনীতে যুক্ত করে নানা ধরনের অপরাধ শুরু করে। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, বসিলা, চাঁদ উদ্যান এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা করতো তারা।
এর আগে গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘ভাইব্বা ল কিং’ নামের একটি কিশোর গ্যাংকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ‘ভাইব্বা ল কিং’ এর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কবির গ্যাংয়ের সদস্যদের সম্পর্কে জানা যায়। গত বছরের ২৯ মার্চ পবিত্র শবেবরাতের রাতে সূত্রাপুরের ফরাশগঞ্জ ঘাটে দুই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বের জেরে ছুরিকাঘাতে জুবলী স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র আরিফ হোসেন অনন্ত (১৭) নিহত হয়। ওই ঘটনায় আহত হয় আরও এক কিশোর। এর আগে গত ৮ জানুয়ারি কামরাঙ্গীরচরে ছুরিকাঘাতে সিফাত (১৪) নামে এক কিশোর নিহত হয়। একই বছর ৩০ আগস্ট ঢাকার ওয়ারীতে দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক কিশোর মুন্নাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে ১০ অক্টোবর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে সহকর্মীর ছুরিকাঘাতে শয়ন হাছান (১৭) নামে এক কিশোর খুন হয়েছে। ওই দুই মামলার বাদীকেও আসামির লোকজন হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের ২১ জুন কিশোর গ্যাংয়ের হাতে পুরান ঢাকার আগামসী লেনে আহমেদ বাওয়ানী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র কিশোর ইমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ওই ঘটনায় বংশাল থানায় হত্যা মামলায় পাঁচ আসামিকে আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করলেও কিছুদিন পরে দুই আসামি জামিনে বেরিয়ে এসে মামলার বাদী ও পরিবারকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারা দেশে সদ্য অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত কয়েক হাজার কিশোরের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যারা বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। কিশোর গ্যাং এখন রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত নেতাদের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হচ্ছে। খোদ রাজধানীতেই এখন পর্যন্ত ৭৮টি কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে কাজ করছে গোয়েন্দা বাহিনী। পুলিশের কিশোর গ্যাংকে নিয়ে তালিকায় মিরপুর এলাকাকে রেড জোন হিসেবে দেখানো হয়েছে। এরপর যথাক্রমে তেজগাঁও, উত্তরা, রমনা এবং লালবাগসহ একাধিক স্থানের কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ করতে হলে আগে এর উৎস খুঁজে বের করতে হবে। কী কারণে তারা বিপদগামী হচ্ছে এটা হতে পারে কুসঙ্গ, মাদক, হতাশা। এসব কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী তাদেরকে কাউন্সেলিং করা, তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করে প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন ও প্ল্যানিং) হায়দার আলী খান বলেন, খারাপ সঙ্গ, মাদকদ্রব্যসহ নানা কারণে কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। এটা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পক্ষ থেকে শুধু রাজধানীতে নয় সারা দেশব্যাপী তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্যাংয়ের লিডার কারা, তারা কী ধরনের কর্মকাণ্ড করছে তার সার্বক্ষণিক মনিটর করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার তদন্ত করে দোষী হলে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিশোর অপরাধীদের জন্য যেহেতু বিশেষ আইন রয়েছে। তাই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।