বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:২১ অপরাহ্ন

“জীবনের সাথে যুদ্ধ করি হামরা বাঁইচপার চাই”

জিন্নাতুল ইসলাম জিন্না, লালমনিরহাট প্রতিনিধি:: হামরাও (আমরাও) এলা (এখন) কামাই (রোজগার) করি (করে) হামার সংসার চালাই। ছওয়া-পোয়াক (ছেলে-মেয়ে) কে লেখা পড়া করাই, হামারও এলা স্বপন (স্বপ্ন) দেখি। বেটিছাওয়া গুলা (নারীরাও) এলা কোন কামতে (কাজে) পাছত (পিছনে) নাই। জীবনের সাথে যুদ্ধ, সংগ্রাম করি হামরা এলা বাঁইচপার চাই। আগোত (আগে) হামাক জমির কাজে কাও (কেউ) ডাকায় (ডাকে) নাই। এলা হামরা ক্ষেতের কাজ করি সংসার চালাই। তিস্তার চরত (চরে) এলা মেলা (অনেক) ফসল হয়। এই জন্যে এলা হামার কাজের অভাব নাই। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তিস্তা চরাঞ্চলের পঞ্চাশোর্ধ নারী আলেয়া বেওয়া। তাই ফসলের মাঠ জুরে নারীদের ঘাম ঝরানো শ্রমে হাসি ফুটেছে চরাঞ্চলের নারীদের মুখে।

শুধু আলেয়া নয় আলেয়ার মত আরও শত শত নারী এখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত করতে হচ্ছে জীবন যুদ্ধ। সচ্ছলতা ফিরে আসছে সংসারিক জীবনে। শুধু অন্যের জমিতে কাজ করেই সংসার চালান না এসব নারী। জমিতে ফসল চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে অনেকেই। চরাঞ্চলের জমিতে নারীরা চাষাবাদ করছে ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, পেয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন ফসল। সংসারে বাড়তি আয় করতে নারীরা গাভী পালন করে। তাদের সেই গাভী চরাঞ্চলের খোলা মাঠে ঘাস ও লতাপাতা খাইয়ে বড় করে বিক্রি করে এখন অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

বিধবা নারীদের অনেকেই সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন, দু মুঠো ভাত পেটে দিতে অন্যের জমিতে শ্রম দিতে হচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ১৭০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান তারা। শুষ্ক মৌসুম জুড়ে প্রায় দিন কাজ করতে হয় তিস্তার চরে। সোনালি ফসলে হাত পড়ে সেইসব নারীদের। দিনের শেষ সময়ে গাভী পালনে চরাঞ্চল দাপিয়ে বেড়ায় নারীরা।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, তিস্তার চরে এবছর জমির পরিমাণ ১০ হাজার ৮০০ হেক্টর। যার মধ্যে ৮ হাজার ৫০০শত হেক্টর জমিতে ফসলের চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ফসল হচ্ছে ভুট্টা। আর এই ভুট্টা লালমনিরহাটে একটি ব্রান্ডিং ফসল হিসেবে পরিচিত। এবছর জেলায় ভুট্টার চাষাবাদ হয়েছে ৩২ হাজার ৯শত ২০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ২০ শতাংশ জায়গা জুরে রয়েছে চরাঞ্চল।

তিস্তা চরের কালমাঠি এলাকার বাসিন্দা আমেনা বেওয়া (৫৫) বলেন, স্বামী নাই, সংসার তো মোকে (আমাকে) চালাইতে হইবে। হামরা মহিলা দেখি আগোত হামাক কাও কাজে নেয় নাই। এলা হামাকও কাজে নেয়। ১৭০ টাকা দিনত পাই। গঞ্জত (বাজারে) চাউলের যে দাম, ফের কাচা তরকারি, ময়-মসল্লা আছে। এই টাকা দিয়া টানা টানি করি সংসার চলে। তারপরও হামরা এলা আগের থাকি একনা (একটু) ভালো আছি।

একই এলাকার নাজমা বেগম (৪৫) বলেন, জামাই (স্বামী) কামাই (কাজ) করে তিস্তার চরত। সেটে তামরা (সেখানে তিনি) ২৫০ টাকা পায়, এই টাকা দিয়াও সংসার চলে না। ছওয়া পোয়াক লেখা পড়া কোরবারও (করতেও) পাইনা। তাই স্বামী যখন কাজে যায়, মুইও (আমিও) মাঝে মাঝে স্বামীর সাথে কাজে যাই। কাজ থাকি আসি আবার দুইটা গরু পালি, তাদের নিয়ে আবার ঘাস খাওয়াইতে যাই। বাড়ির উঠানে শবজির বাগান করছি, এই সবজিগুলো হামার এই ঠাকার গ্রামের বাজারড বেচাই। এমন করি আস্তে আস্তে সংসার সাজামো হামরাও।

লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারি উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তার বিস্তীর্ণ চরে চাষিরা ফলাচ্ছেন সোনার ফসল। আর ফসলের মাঠ জুরে নারীদের ঘাম ঝরানো শ্রমে হাসি ফুটেছে চরাঞ্চলের নারীদের মুখে।

সমাজকর্মী, লেখক, কবি ও গবেষক ফেরদৌসী বেগম বিউটির সাথে নারীদের এই জীবন সংগ্রাম নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে লালমনিরহাট জেলার ইতিহাসে তিস্তা ধরলার মানুষের হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে। তিস্তার নারীদের জীবন হচ্ছে ভাঙ্গা গড়া। তারা জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। এখানে প্রান্তিক দুর্যোগে নিপীড়িত ঝড়-ঝঞ্ঝা বর্ষা তিস্তা চরের মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেখানেই তারা এখন বাড়ির উঠোনে প্রান্তিক জমিতে চাষাবাদ করে, হাঁস-মুরগি গাভী পালনে তারা এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী।

আগে তিস্তা চরের শিশুরা স্কুলে যেতে চাইতো না বা যেত না, সেই শিশুরাও এখন স্কুল মুখি। তাদের ইচ্ছে শক্তি এতই প্রবন যে তারাও এখন জেনে গিয়েছে আমাদেরও লেখাপড়া শিখতে হবে। নারীরা এখন কোনো কাজেই পিছিয়ে নেই, শিক্ষা, দীক্ষায়, ক্ষমতায় এবং অধিকারে অনেক সচেতন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com