বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫, ০৪:৪১ অপরাহ্ন
এস.এম. সাঈদুর রহমান সোহেল, খুলনা ব্যুরো::
খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী গ্রামে প্রতিপক্ষের গুলি ও পাল্টা হামলায় ৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনার দু’দিন পরও এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গ্রামজুড়ে রক্তের ছাপ এবং আসবাবপত্র পোড়ার গন্ধ ছড়িয়েছে। কিন্তু এখনও গ্রেফতার হয়নি ঘটনার মূল অভিযুক্ত শেখ জাকারিয়া। সে রয়েছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে, ঘটনার দু’দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যাকান্ডের ঘটনায় কেউ মামলা দায়ের করেনি। এ ঘটনায় মুল অভিযুক্ত শেখ জাকারিয়ার ছোট ভাই ছাত্রলীগের বহিস্কৃত নেতা শেখ জাফরিন হাসানকে শনিবার গোয়েন্দা পুলিশ যশোর থেকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া মূল অভিযুক্তদের ঘনিষ্টজন জাহাঙ্গীরকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বলেছে পুলিশ।
অপরদিকে, ঘটনার মূল হোতারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে দলের অবস্থান পরিস্কার করেছেন নেতারা। তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে বলেছেন, এ ঘটনা দলীয় কোন বিষয় না, ব্যক্তি কেন্দ্রিক, যার দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের, দলের নয়। দল কোন ব্যক্তির অপকর্মের দায়ভার বহন করবে না।
ঘটনার নেপথ্যে :
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার খানজাহান আলী থানা পুলিশকে অস্ত্রসহ মুজিবর নামের এক নিরাপরাধ ব্যক্তিকে ধরিয়ে দেয় জাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের নেতা জাকারিয়া ও তার ভাই জাফরিন। মুজিবরকে গ্রেফতারের বিষয়ে এলাকাবাসী জাকারিয়াকে জিজ্ঞাসা করতে যায়। ওই বাড়ির সামনে যাওয়ার পর কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে জাকারিয়া ও জাফরিন স্থানীয়দের উপর গুলিবর্ষণ করে। এ থেকে সংঘর্ষের ঘটনার সূত্রপাত হয়। তবে কেউ কেউ বলছেন, মশিয়ালী শামসুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনে খানজাহান আলী থানা আ’লীগের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মোঃ জাকারিয়া সভাপতি পদে পরাজিত হন। এ ঘটনার জেরধরে স্থানীয়দের সাথে তার বিরোধের সূত্রপাত হয়। জাকারিয়া বাহিনীর গুলিতে নজরুল ইসলাম, গোলাম রসুল ও সাইফুল ইসলাম এবং ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে জাকারিয়ার চাচাতো ভাই শেখ জিহাদসহ চারজন নিহতের পর সন্ত্রাসী জাকারিয়া ও তার অপর তিন ভাই জাফরিন, মিল্টন ও কবির আত্মগোপন করে। এদের মধ্যে খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের বহিস্কৃত সাবেক সহসভাপতি জাফরিনকে শনিবার বিকালে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অপর তিনভাই এখনো পলাতক রয়েছে। বর্তমানে মশিয়ালী গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অন্যতম হোতা জাফরিন গ্রেফতার :
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির জানান, শনিবার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে কেএমপির গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার দাঁতপুর গ্রাম থেকে মশিয়ালী গ্রামের হত্যাকা-ের ঘটনার মূলহোতা সন্ত্রাসী জাকারিয়ার অন্যতম সহযোগী ও তার আপন ছোটভাই শেখ জাফরিনকে গ্রেফতার করেছে। বাকি অভিযুক্তদেরকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) সোনালী সেন জানান, অপরাধীদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া থানায় মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিন সহোদরের যত অপকর্ম :
শেখ জাকারিয়া হাসান, শেখ জাফরিন হাসান ও শেখ মিল্টন হাসান। তিন সহোদর। খুলনার খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী গ্রামের বাসিন্দা মৃত হাসান আলী শেখের ছেলে। অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে এগিয়ে। তাই সাধারণ গ্রামবাসী তাদের কাছে তুচ্ছ। এ কারণে তাদের আনুগত্যের বাইরে গেলেই নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ। আর পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে হয়রাণি তো আছেই। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবারও জাকারিয়া একজন সাধারণ গ্রামবাসীকে অবৈধ গুলি দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার পর থেকেই স্থানীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। যার পরিণতিতে নির্বিচারে গুলি চালানো হয় তাদের বুকে। ঝরে যায় তিনটি তাজা প্রাণ। বুলেট বিদ্ধ হয়ে এখনও আরও ১০-১৫জন নিরিহ গ্রামবাসী হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন।
এদিকে, এ ঘটনার পর ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর ক্ষোভ বিস্ফোরণে পরিণত হয়। যার ফলাফল হিসেবে হামলাকারী জাকারিয়াসহ তার আরও দু’ সহোদরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করা হয়। এমনকি জাকারিয়ার চাচাতো ভাইকে শেখ জিহাদকে গণপিটুনী দিয়ে হত্যা করা হয়। গ্রামবাসীর এ তান্ডব শুক্রবারও অব্যাহত ছিল।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, জাকারিয়ারা তিন ভাই মূলত: খানজাহান আলী থানার ওসিকে ব্যবহার করেই তাদের ওপর অত্যাহার-জুলুম চালাতো। বিপক্ষে গেলেই পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে হয়রাণি করতো। এ জন্য তারা ওসি এসএম শফিকুল ইসলামের অপসারণ দাবি করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জাফরিন ও জাকারিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা সহ একাধিক মামলাও জিডি রয়েছে। জাফরিন ও জাকারিয়া বাহিনীর ভয়ে অনেকেই এলাকা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এছাড়া এর আগেও মশিয়ালী গ্রামের ফকিরপাড়ায় মিটুল নামে এক যুবকের সাথে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জাফরিন ও তার ভাই জাকারিয়ার সংর্ঘষ হয়। তবে, জাকারিয়া ও জাফীরনের সঙ্গে খানজাহান আলী থানার ওসি শফিকুল ইসলামের সখ্যতা থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে অপরাধ করেও তারা পার পেয়ে গেছে বলে স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশের সূত্র জানান, জাফরিন ও জাকারিয়া স্থানীয় ডাক্তার বাড়ির মোমিন ড্রাইভারে ছেলে সাইফুল হত্যা মামলার আসামি। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও মামলা রয়েছে। অপর ভাই মিল্টন অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে জামিনে মুক্তি পায়। গুলিতে নিহত নজরুল ইসলামের চাচাতো ভাই রজব আলী শেখ অভিযোগ করেন, মুজিবরের ছোট ভাইকে সাজানো মামলায় পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়ার প্রতিবাদ করায় তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। এলাকায় এমন কোন খারাপ কাজ নেই- যা জাকারিয়ারা করে না। এর পেছনে বকতিয়ার মেম্বর ও মনিরুল চেয়ারম্যানও জড়িত। এছাড়া ওসিই হচ্ছে তাদের ইন্দনদাতা বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মশিয়ালী গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, জাকারিয়াদের কাছ থেকে ওসি শফিকুল ইসলাম অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন। এ জন্যই তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদি তিনি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতেন তাহলে এই ধরনের হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটত না। স্থানীয় আটরা-গিলাতলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জাকারিয়াদের চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাইই সন্ত্রাসী। তাদের ভয়ে এলাকার লোকজন কথা বলতে পারে না। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই তারা তাদেরকে মারধর এমনকি পুলিশ দিয়ে হয়রানি করত। এছাড়া তারা এলাকার বড়ো সুদের কারবারি। ১০০টাকায় তারা প্রতি মাসে ১০টাকা করে সুদ আদায় করত। কেউ নির্ধারিত সময়ে সুদের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তারা তাকে নির্যাতন করত।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খানহাজান আলী থানার ওসি এসএম শফিকুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তবে, আটরা-গিলাতলা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ মনিরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
দায় নেবে না আওয়া লীগ :
শনিবার এক বিবৃতিতে খুলনা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ঘটনার সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। দলের মহানগর শাখার দপ্তর সম্পাদক মো. মুন্সি মাহবুব আলম সোহাগ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বলেন, জাফরিনের কর্মকান্ডের কারনে আগেই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর সম্প্রতি মশিয়ালিতে সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যার সাথে সম্পৃক্ত থাকায় জাকারিয়াকে খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, আওয়ামী লীগ কোন সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেয় না। সুতরাং জাকারিয়া, জাফরিন ও মিলটনের মত চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের তো প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আওয়ামী লীগ সব সময়ই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে থাকে। সুতরাং মশিয়ালিতে সংঘটিত ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি করতে হবে। নেতৃবৃন্দ অনতিবিলম্বে ঘটনার সাথে জড়িতেদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান।
বিবৃতিদাতারা হলেন- শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এমপি, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সিটি মেয়র আলহাজ্ব তালকদার আব্দুল খালেক, সংসদ সদস্য সেখ সালাহ্ উদ্দিন জুয়েল, দলের জেলা সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ, কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, মহানগর সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা, জেলা সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. সুজিত কুমার অধিকারী প্রমূখ।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) রাতে খুলনার খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী এলাকায় জাকারিয়া বাহিনীর গুলিতে মারা যান আটরা আটরা গিলাতলার মশিয়ালী এলাকার মৃত মোঃ বারিক শেখের ছেলে মোঃ নজরুল ইসলাম (৬০) ও একই এলাকার মোঃ ইউনুচ আলীর ছেলে গোলাম রসুল (৩০)। এ সময়ে গুলিবিদ্ধ হন মোঃ সাইফুল ইসলাম, আফসার শেখ, শামীম, রবি, খলিলুর রহমান ও মশিয়ার রহমানসহ আরও কয়েকজন। এর মধ্যে আহত সাইফুল ইসলাম শুক্রবার সকালে মারা যান।
অপরদিকে, বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী গণপিটুনী দিয়ে জাকারিয়া বাহিনীর সদস্য জিহাদ শেখকে হত্যা করে। এ ঘটনায় ৪জন নিহতের ঘটনা ঘটে।