মঙ্গলবার, ০৫ অগাস্ট ২০২৫, ০৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

অপপ্রচারের ভয়াবহ পরিণতি

গোলাম মাওলা রনি:
বিগত দুই শতাব্দীর মধ্যে ব্যক্তিপর্যায়ে রাষ্ট্রীয় পদে থেকে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচারের জন্য যাকে দায়ী করা হয়, তার নাম গোয়েবলস। কুখ্যাত হিটলারের প্রচারমন্ত্রী হিসেবে অনবরত মিথ্যাচার এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচার করে শত্রু-মিত্র সবাইকে গোয়েবলস যেভাবে হতবাক করে দিতেন সেভাবে আজ অবধি কেউ তার সমপর্যায়ে যাওয়া তো দূরের কথা নিকটবর্তীও হতে পারেনি। গোয়েবলস যে কাজগুলো করতেন, তা রাষ্ট্রশক্তির প্রচারমন্ত্রীরা অনাদিকাল থেকেই করে আসছিলেন। কিন্তু তারা কেউই গোয়েবলসের মতো করে আপন পক্ষ, প্রতিপক্ষ এবং নিরীহ পৃথিবীবাসীর ধ্বংস সাধন করতে পারেননি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি কিংবা অন্যায়-অত্যাচার করেননি। কোনো রকম দুর্নীতি কিংবা অন্য কোনো অনাচারের সাথেও জড়িত ছিলেন না। তিনি কেবল অত্যন্ত সুকৌশলে এবং সাবলীলভাবে মিথ্যাচার এবং অতীব দক্ষতার সাথে অপ্রচার চালিয়ে শত্রুপক্ষের শক্তিমত্তা এবং ক্ষয়ক্ষতি করার সক্ষমতাকে ছোট করে জনগণকে ধোঁকা দিতেন। অন্য দিকে, নিজেদের ক্ষমতাকে বহু গুণ বাড়িয়ে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে বিশ্ববাসীকে অহেতুক ভয় দেখাতেন।

গোয়েবলসের অপপ্রচার, মিথ্যাচার এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্যসন্ত্রাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে গত ৭৩ বছর ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা ধরনের গবেষণা চলে আসছে। তিনি কেনো মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালাতেন, তার কর্মকাণ্ডে হিটলার এবং তার মিত্রদের কী কী লাভ-ক্ষতি হয়েছিল অথবা হিটলারবিরোধী মিত্রশক্তির লাভ-ক্ষতিইবা কেমন ছিল! রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে অপ্রচার ও মিথ্যাচারের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লাভ-ক্ষতির খতিয়ান বের করার জন্য গবেষকেরা গোয়েবলসের কর্মকাণ্ডগুলোর চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাপর নানা ঘটনা দুর্ঘটনা সম্পর্কে এমন অকাট্য প্রমাণ দাঁড় করিয়েছেন, যা আপনি জানলে কোনো দিন মিথ্যাচার কিংবা অপপ্রচারের দিকে ফিরেও তাকাতেন না। আজকের লেখা আমি সংক্ষিপ্ত আকারে অনেকটা নিজের মতো করে গোয়েবলসের অপকর্মের নেপথ্য কারণ এবং ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করব।

প্রথমত, অপ্রচারকারীরা নিজেদের ব্যাপারে প্রচণ্ড সন্ধিহান থাকেন। তাদের আত্মমর্যাদা, শক্তিমত্তা, সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্থ-বিত্ত-প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। তারা নিজেদের অবস্থানের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন এবং আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজেদের জন্য একটি কল্পিত জগৎ সৃষ্টি করেন। এরপর সেই কল্পিত জগতকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে প্রতিপক্ষসহ অন্যান্য পক্ষের কাছে তা উপস্থাপনের জন্য মিথ্যাচার আরম্ভ করেন। এই শ্রেণীর অপপ্রচারকারীরা ধনী না হয়ে বিত্তের বড়াই করেন- কুলটা হওয়ার পরও চরিত্র নিয়ে দাম্ভিকতা দেখান। রোগগ্রস্ত শরীর ও বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের কসরৎ এবং নিজেকে সুখী প্রমাণের জন্য অহেতুক বাহুল্যময় আনন্দফুর্তির আয়োজন করে বালখিল্যময় ক্রীড়া-কৌতুকে মত্ত হয়ে পড়েন। তারা ক্রমাগত মিথ্যাচার করতে করতে একসময় মানসিক বিকারগ্রস্ত, ভাবলেশহীন এবং নির্জীব জড়পদার্থের মতো অনুভূতিহীন হয়ে পড়েন। ফলে তাদের কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনা অথবা তাদের ঘিরে সাধারণ মানুষের ঘৃণা-বিরক্তি-অভিশাপ ইত্যাদি আঁচ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
অপপ্রচারকারীরা দ্বিতীয়পর্যায়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও মিথ্যাচার চালাতে থাকেন। এক ধরনের হীনম্মন্যতা, ভীরুতা এবং প্রতিপক্ষ সম্পর্কে অতিরিক্ত ভয় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তারা অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে থাকেন। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা এবং ক্ষতি করার ক্ষমতা সম্পর্কে আতঙ্কিত বোধ করেন। সম্মুখসমর কিংবা বিধিবদ্ধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তারা প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার বিশ্বাস, মনোবল এবং যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। এই অবস্থায় মন্ত্র-তন্ত্র বা ভৌতিক উপায়ে সফলতা লাভের মতো মনোবৃত্তির দাস হয়ে তারা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে পড়েন। কাপালিকের মতো ভণ্ডামী ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে তারা আপন-পর সবাইকে ধোঁকা দেয়া আরম্ভ করেন। প্রতিপক্ষের চরিত্র হরণ, তাদের হীনতর, দুর্বলতর এবং নিকৃষ্টরূপে উপস্থাপনের জন্য এহেন কুকর্ম নেই, যা অপপ্রচারকারীরা করেন না বা করতে পারেন না।

আলোচনার এইপর্যায়ে আমরা অপপ্রচারকারী মিথ্যাচারীদের নৈতিক চরিত্র, মনোবৃত্তি এবং বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কিছু তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা করব। সাধারণত অস্থির প্রকৃতির এবং নীচু মনমানসিকতাসম্পন্ন না হলে কেউ অপ্রচারে যেমন লিপ্ত হতে পারেন না, তেমনি অপপ্রচারের গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেদের ভাসিয়ে আত্মপ্রবঞ্চনা করতে পারেন না। তারা সাধারণত চরিত্রহীন, বজ্জাত প্রকৃতির হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি নতুবা অতিমাত্রার স্বপ্নবিলাসী উচ্চাকাক্সক্ষী হয়ে থাকেন। তাদের বুদ্ধিমত্তা তাদের আশপাশের লোকজন এবং প্রতিপক্ষের তুলনায় কম হয়ে থাকে। তবে ক্ষমতা, অর্থ, পদপদবি, সময় ও সুযোগের কারণে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন অথবা ছলে বলে কৌশলে সুবিধাজনক অবস্থান দখল করে নেন। যেহেতু তারা শুভ কর্ম এবং যোগ্যতা বলে কোনো কিছু অর্জন করেন না- সেহেতু তারা পদপদবিতে থেকেও এক ধরনের প্রাকৃতিক অনিরাপত্তাবোধে ভোগেন এবং তা থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যাচার ও ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন।

অপপ্রচারকারীদের জ্ঞান-গরিমা কাক্সিক্ষত মানের না হওয়ার কারণে তারা নিজেদের অবস্থান, প্রতিপক্ষের মর্যাদা এবং সাধারণ মানুষের আবেগ অনুভূতিকে ধারণ ও মূল্যায়ন করতে পারেন না। তারা বিদ্যা অর্জনের চেয়ে বিদ্যাধারী হওয়ার চেষ্টা করেন। তারা পরিশ্রমহীন অর্জন, কানকথা শ্রবণ, এবং দমন-পীড়নে আসক্ত হয়ে পড়েন। সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার মনোবৃত্তি, নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুলে ধরার অপচেষ্টা, দায়িত্ব এড়িয়ে নিজেদের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রচেষ্টা এবং সবসময় খাই খাই ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব না থাকলে কেউ অপপ্রচারকারী হতে পারেন না। নিষ্ঠুরতা এবং অশ্লীলতা অপপ্রচারকারীদের প্রধান দু’টি হাতিয়ার। নীচুতা ও ভীরুতা হলো তাদের অন্যতম অলঙ্কার। দুর্ব্যবহার এবং দাম্ভিকতা হলো তাদের পরিচ্ছদ এবং চরিত্রহীনতা হলো তাদের মাথার মুকুট। কৃপণতা, লোভ-লালসা এবং অন্যের ধন হরণ করার দুর্বৃত্তপনা হলো তাদের প্রাণশক্তি। মিথ্যাকে বাহন বানিয়ে, ভণ্ডামী ও ভাঁওতাবাজিকে ঘর বানিয়ে অপপ্রচারকারীরা যে তাণ্ডব চালান তাতে তার পারিপার্শ্বিক ঘরসংসার, সমাজ এবং রাষ্ট্র লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

অপপ্রচারকারী মিথ্যাচারীরা তাদের কুকর্মের জন্য সর্বদা অনুগত বশংবদ এবং তাঁবেদার দর্শকশ্রোতা পয়দা করে থাকেন। তারা বড় শয়তান হিসেবে নিজেরা যেমন দশ মুখে প্রচার করেন, তেমনি তাদের কথাগুলো শত শত মুখে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ছোট শয়তানের মতো অসংখ্য বশংবদ এজেন্ট বা প্রতিনিধি সৃষ্টি করেন। তারা তাদের কথা শুনে তালি বাজানোর জন্য তাবেদার সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের কথা-কর্মের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী, কবিসাহিত্যিক, অভিনেতা ও আধ্যাত্মিক নেতা পয়দা করেন। মিথ্যাচারের দলিল সৃজনের জন্য অপপ্রচারকারী দলিল লেখক, দলিল পাঠক এবং তা সংরক্ষণের জন্য গুদামঘর নির্মাণ করেন। তারা নিজেরা আলোর মধ্যে থেকে অন্ধকারের স্বাদ গ্রহণের জন্য এক ধরনের রঙিন চশমা পরেন এবং তাদের অনুগত পাপেট শ্রেণীকেও একই ধরনের রঙিন চশমা পরানোর ব্যবস্থা করেন। ফলে তারা শত্রু-মিত্র, আপন-পর; সমাজ-সংসার ইত্যাদি কোনো কিছুই সঠিকভাবে দেখতে পারেন না।
অপপ্রচারের প্রতিক্রিয়া সর্বদা মাদকের মতো প্রাণ সংহারী হয়ে থাকে। মাদক যেমন সেবনকারীকে বুদ্ধিহীন, অনুভূতিহীন বানিয়ে এক কল্পনার জগতের মধ্যে ঢুকিয়ে তাকে তিলে তিলে মেরে ফেলে। ঠিক তেমনি মিথ্যাচার ও অপপ্রচার মানুষকে শেষপর্যন্ত চরম ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে নেশাখোর যেমন কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে যেকোনো কর্ম করতে দ্বিধা করে না, তেমনি অপপ্রচারকারীরাও তাদের কর্মের পূর্বাপর পরিণতি নিয়ে মাথা ঘামান না বরং এক ধরনের আত্মতৃপ্তি তাদের আরো অপরাধপ্রবণ করে তোলে। হিংসা-দ্বেষ, কলহ-বিবাদ, নিজের স্বার্থের ব্যাপারে অনৈতিক বাড়াবাড়ি এবং অপরের স্বার্থহানির ব্যাপারে সীমাহীন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অপপ্রচারকারীরা প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন অনাসৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তাদের দাম্ভিকতার তাণ্ডবে পৃথিবীর আলো-বাতাস-পানি বিষময় হয়ে ওঠে।
অপপ্রচারের দ্বারা দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এমন কোনো ঘটনা আজ অবধি লিখিত হয়নি। বরং অপপ্রচারের ফলে অপ্রচারকারীদের সর্বাত্মক ক্ষয়ক্ষতি, অনাসৃষ্টি এব ক্ষেত্রবিশেষে তাদের সমূলে বিনাশ হওয়ার ঘটনার বহু নজির পৃথিবীময় কালে কালে বর্ণিলভাবে সৃষ্টি হয়েছে। অপপ্রচারের ফলে সবার আগে অপপ্রচারকারী নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তারপর তার বিশ্বস্ত, অনুগত ও শুভানুধায়ীদের ক্ষতি করে থাকেন এবং সবশেষে তিনি যার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেন তাকে লাভবান বানিয়ে দেন। অপপ্রচারে মোহাবিষ্ট হয়ে অপপ্রচারকারী এবং তার বশংবদেরা এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে ভুগতে কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাদের সাহস-শক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও প্রতিরোধ করার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। অন্য দিকে এরা বিভিন্ন অপপ্রচার ও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে প্রতিপক্ষকে জীবনযুদ্ধের মাঠে ঠেলে দিয়ে মূলত তাদের ধৈর্য-সহ্য শক্তি এবং লড়াই সংগ্রাম করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেন। ফলে একটি সময়ে যখন উভয়পক্ষের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন অপপ্রচারকারীরা সামান্যতম প্রতিরোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে পিছুটান দেন। তারা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করেন, নতুবা আত্মহত্যা করেন। তাদের অপদার্থ বশংবদেরা পালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাসের কারণে আত্মহত্যার পথে পা বাড়ানোর সাহস পান না। ফলে তারা সর্বদা প্রতিপক্ষের হাতে ধরা পড়েন এবং নির্মম পরিণতির শিকার হন।

আমরা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার, তার অনুগত নাৎসি বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের করুণ পরিণতি পর্যালোচনা করি তবে আজকের নিবন্ধের প্রতিটি শব্দের স্বার্থকতা খুঁজে পাবো। এডলফ হিটলার নিজে এবং তার প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস প্রথমেই দেশবাসীকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, একমাত্র হিটলারের নেতৃত্বেই জাতীয় উন্নয়ন এবং জার্মান জাতীয়তাবোধকে রক্ষা করা সম্ভব। জনগণকে বোকা বানিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে হিটলার রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় ব্যাপক কর্তৃত্ব অর্জন করার পর তার ক্ষমতার মোহ এবং অপপ্রচারের ধোঁকাবাজির জাদুকরী ফলাফল আরো বিস্তৃত অঞ্চলে প্রয়োগ করার জন্য তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে প্রথমে বিবাদ এবং পরে যুদ্ধ আরম্ভ করে দেন। নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিপক্ষের মনে অহেতুক ও অকারণ ভয় ধরিয়ে দিয়ে পুরুশিয়া, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে আক্রমণ করে ইউরোপের বিরাট অংশ দখল করে নেন। মধ্যপ্রাচ্য, দুরপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও হিটলারের সহযোগীরা প্রথম দিকে ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে থাকে। কিন্তু পরে যখন প্রতিপক্ষ মিত্রশক্তি তার ক্ষমতা ও দম্ভের নেপথ্য কারণ আবিষ্কার করে প্রথমে প্রতিরোধ এবং কিয়ৎকাল পরে পাল্টা হামলা করে বসেন তখন হিটলারের নাৎসিবাদের সাম্রাজ্য তাসের ঘর বা বালির বাঁধের মতো ধসে পড়ে।

হিটলারের পতনের পর তার দুর্দান্ত প্রতাপশালী তথাকথিত যুদ্ধজয়ী ফিল্ড মার্সালদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই যাননি। কেউ কেউ যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছিলেন বটে- কিন্তু তাদের যুদ্ধ জয় নিয়ে হিটলারের প্রচারমন্ত্রী যেভাবে তাদের মহানায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন তারা তার এক শতাংশ সফলতাও দেখাতে পারেননি। বিশেষ করে ফিল্ড মার্শাল রোমেল সম্পর্কে যে অতিরিক্ত প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল তাতে জার্মান জনমত হিটলারের পরিবর্তে জেনারেল রোমেলকেই জাতির ত্রাণকর্তা ভেবে বসেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধরত এবং কার্যত পরাজিত ও বিধ্বস্ত রোমেল এসব কিছুই জানতেন না, এমনকি হিটলারের সাথে তার ব্যক্তিগত পরিচয় পর্যন্ত ছিল না। তার ভুয়া বীরত্বকে সংবর্ধনা দিয়ে জাতিকে উজ্জীবিত করার নামে বিভ্রান্ত করার জন্য গোয়েবলসগং যখন তৎকালীন জার্মান রাজধানীতে রোমেলের জন্য গণ-সংবর্ধনার আয়োজন করেন, তখন স্মরণকালের বৃহত্তম গণ-সমাবেশ দেখে রোমেল বেকুব বনে যান এবং হিটলার আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরের ইতিহাস সবার হয়তো জানা আছে। আমি এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় গিয়ে আজকের নিবন্ধের পরিধি না বাড়িয়ে উপসংহারে চলে যাই।

অপপ্রচার এবং মিথ্যাচারের মাধ্যমে জমিনে বান্দা এবং আল্লাহ উভয়ের হক নষ্ট করা হয়। সত্যকে কবর দিয়ে মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে ধোঁকাবাজির উদ্যান সৃষ্টি করে জমিনের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করা হয়। জমিনের স্বাভাবিক কোলাহল, কলবর, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা স্তব্ধ করে দিয়ে মিথ্যাবাদী অপপ্রচারকারীরা শিরকের মতো ভয়াবহ গুনাহ সংঘটিত করার প্রয়াস চালিয়ে জমিনে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানোর মাধ্যমে প্রকৃতির আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে থাকেন। ফলে তারা যখন নিয়তির ফাঁদে আটকা পড়ে যান তখন আসমান-জমিন-পাহাড়-সমুদ্রের প্রতিটি সহায়ক শক্তি বা সাহায্যকারী শক্তি, বৃক্ষ-লতা, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ এবং মানুষ তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। তারা তখন পালাবার কোনো জায়গা পান না কিংবা লুকিয়ে থাকার জন্য স্থানও পান না। একমাত্র ধ্বংস এবং সমূলে বিনাশ হওয়ার পরিণতি ভোগ করে তারা বহুকাল অবধি পৃথিবীবাসীর ঘৃণা ও অভিশাপ কুড়াতে থাকেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।
সুত্র-নয়াগিন্ত

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com