বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৪:১৪ অপরাহ্ন
শুণ্য হাতে বাসায় ফিরলেন আকবর আলী। কয়েকদিন ধরে তার ছোট মেয়ে আলোমতি রোজা রেখেছে। সে বাবার কাছে আরব দেশের খেঁজুর খেতে চেয়েছে কিন্তু কোন ভাবেই আকবর আলী মেয়ের জন্য কয়েক পিচ খেজুর সংগ্রহ করতে পারেনি। মেয়েটা ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো, পকেট হাতালো কিন্তু একটিও আরব দেশের খেজুর পেলোনা। অভিমানে বাবাকে কিছু না বলে অন্যদিকে ছুটে চলে গেলো। আকবর আলীর বুকের ভিতরটা হু-হু করে কেঁদে উঠলো। মসজিদে-মসজিদে পবিত্র রমজানে বিভিন্ন সওয়াবের কথা আলোচনা হয়। দান-সদকা করার কথা শুনে এদেশের ধণীরা পুলোকিত হয় কিন্তু যখনই মসজিদের বাইরে চলে আসে, তখন-ই তাদের দান হয়ে যায় লোক দেখানো। মহাপবিত্র কুরআন ও হাদিসের অমিয় বাণী শোভা বর্ধন করে চলে পুস্তকের ভিতরে। রমজানের প্রকৃত সৌন্দর্য্য থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ। আরব দেশগুলোর ব্যবসায়ীগণ যখন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতা করে; ঠিক তখনই মুসলীম প্রধান বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা করে। ভাবটা এমন যেন এক রমজানেই দেশের শ্রেষ্ঠ ধণীর কাঁতারভুক্ত হতে হবে। তারাও স্বপ্ন দেখে জান্নাতে গিয়ে হুরের সাথে বাসর করার।
Vegetable vendor on the sidewalk
প্রয়োজনের গুরুত্ব বুঝে বিভিন্ন দ্রব্যাদির দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে বর্ধিত করা একটা ইবলিশি কাজ। কিছু মানুষ রমজানে জিনিসের দাম বাড়িয়ে জান্নাতে যেতে চাই । আবার আমরা সাধারণ জনতা বাধ্য হয়ে সেই সব পণ্য কিনে খাই । অবশেষে আমাদের কিছু সময়ের জন্য বোধদয় হয় । আমরা যদি সবাই মিলে একসাথে হঠাৎ কারণ ছাড়াই বেড়ে যাওয়া জিনিস খাওয়া বর্জন করি। তবে সিন্ডিকেটদের রাস্তায় থালা হাতে বসতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমাদের প্রতিবাদ শুধু মোড়ের চা দোকান কিংবা ফেসবুকের পাতায়। তারপর সেই আগের অবস্থা। চলছে জীবন অন্যের নিয়মে।
হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) নামাজের আগে কয়েকটি কাঁচা খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকতো, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। যদি শুকনো খেজুরও না থাকতো তাহলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে।’ (সুনানে তিরমিজি; রোজা অধ্যায়: ৬৩২)। আঙুর, খেজুরের পরিবর্তে বরই দিয়ে ইফতার করার পরামর্শ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেছেন, আঙুর-খেজুর নয়, বরই-পেয়ারা দিয়ে ইফতার করুন। এই কথার প্রতিবাদে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘গরিব মানুষ বরই খাবে। আর তুমি আঙুর-খেজুর খাবা, তা হবে না’। প্রতিটি বিষয় নিয়ে এদেশের রাজনৈতিক নেতাবর্গ রাজপথে কঠিন হুশিয়ারী দিয়ে এসিরুমে বসে ইফতার করার পরিকল্পনা করে। মাঝখানে হিমশিম খাই গরীব মানুষের ভাগ্য। রাজনৈতিক ধাক্কাধাক্কির ফায়দা লুটে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে । এইসব মানুষই মূলত দো’পেয় মানবরূপি হায়েনা। যাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নামের অতল তলে।
সিন্ডিকেট সৃষ্টি করে নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারকে যারা অস্থীতিশীল করে, সাধারণ জনগণকে কষ্ট দেয় তাদের কোন দোয়া কবুল হবেনা। ইসলামে অসৎ- জালিয়াতি, ধোঁকাবাজি, ভেজাল মেশানো ও দালালি ইত্যাদি নিষিদ্ধ। রসুল (স.) বলেন, ‘কেউ যদি খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দ্বারা শাস্তি দেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস :২২৩৮) সুতরাং দিব্য দৃষ্টিতে মানুষ যেটাকে লাভবানের মূলমন্ত্র মনে করে প্রকৃত অর্থে সেটিই তার ধ্বংসের কারণ।
সাধারণত সিন্ডিকেট, দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধগতি সংক্রান্ত কথা উঠলেই আমরা আমাদের স্ব-দায় এড়িয়ে চলার পায়তারায় সিদ্ধহস্ত। মোড়ের পিঁয়াজু, মুড়ি বিক্রেতার দিকে নজর দিয়না। অথচ সেও কোন না কোন অংশে কম যায়না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যার ক্ষমতা যতটুকু সে ততোটুকুই দূর্নীতি আলিঙ্গনে অভ্যস্থ। রাসুল (সা:) এরশাদ করেন: ঐ সত্বার কসম, যার হস্তে আমার প্রাণ, যে ব্যক্তি কোনো হারাম সম্পদ অর্জন করে, অতঃপর সে এটা দান করে তবে এ দান গ্রহণ করা হবেনা। এর থেকে সে যা কিছু স্বীয় প্রয়োজনে খরচ করবে, এতে বরকত হবেনা। আর যদি সে তা উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যায় এটা তার জন্য জাহান্নামের পাথেয় হবে। কেননা আল্লাহ মন্দ দ্বারা মন্দকে মিটিয়ে দেন না বরং মন্দকে ভালো দ্বারা মিটিয়ে দেন। কোনো অপবিত্রতা অন্য কোনো অপবিত্রতাকে বিলীন করতে পারে না (তিবরানী)। ওই শরীর কখনওই জান্নাতে প্রবেশ করবেনা যে হারাম খাবার খেতে অভ্যস্থ। বর্তমান সুদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষ হারাম-হালালের পার্থক্যই জানেনা। জানতে চেষ্টাও করেনা। নিজের মত করে ব্যাখা বের করে এবং তদনুযায়ী জীবন সাজানোর চেষ্টা করে।
ফাইল ছবি : গরু
রহমতের পয়গাম নিয়ে আমাদের জীবদ্দশায় বারবার মাহে রমজানের আগমন ঘটে। আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু আমাদের জীবন-মান সেই আগের জায়গাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কোন পরিবর্তন হয়না। হবার সম্ভাবনাও লক্ষ্য করা যায়না। কিন্তু আল্লাহর বাণী পাঠে আমরা অবগত হই রমজানে আসে রহমত, মাগফিরাত ও নাযাতের পয়গাম নিয়ে। তার মত হতভাগ্য মানুষ আর কে হতে পারে যে, তার জীবদ্দশায় রমজান পেলো অথচ জাহান্নাম হারাম করে জান্নাতের পথ সুগম করতে পারলোনা।
রমজান মাস দোয়া কবুলের মাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘রমজান মাসে প্রত্যেক মুসলিমের দোয়া কবুল করা হয়।’ (মুসনাদ আহমদ)। অন্য হাদিসে রয়েছে, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রমজানের প্রতি রাতে ও দিনে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন এবং প্রতি রাত ও দিবসে মুসলিমের দোয়া-প্রার্থনা কবুল করা হয়।’ (সহি আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব)। রমজানে নিন্ম আয়ের অসহায় মানুষেরা ধনাঢ্যদের পানে বুকভরা আশা নিয়ে চেয়ে থাকেন। গরীব-অসহায়জনের দুঃখ দূরকরণে ধনাঢ্যদের উচিৎ দানের হাত বর্ধিত করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ওপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম।’ (বুখারি : ১৪২৭)। একথা আমরা সকলেই জানি মাহে রমজানে দানের ফজিলত অনেক বেশি। অন্য ১১ মাসের তুলনায় রমজান মাসে অধিক দান-সদকা করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উদার ও দানশীল ছিলেন। রমজানে যখন হজরত জিবরাইল (আ.) তার কাছে নিয়মিত আসতেন এবং কোরআন পড়ে শোনাতেন, তখন তার দানশীলতা আরও বেড়ে যেত। আনাস (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.)-এর চেয়ে বেশি দানশীল আমি আর কাউকে দেখিনি।’ (মুসলিম)
আমাদের পাপরাজীর ক্ষমা প্রার্থণা করে আমাদের জীবনকে পূর্ণ করণের এখনই সময়। মাহে রমজানের এই মহা পবিত্র মাসে আমাদের সকলের একমাত্র উদ্দেশ্য হোক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আগামী বছর আমাদের জীবনে আবারও রমজান পাবো এর কোন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং কোন ভাবেই যেন এবারের রমজান থেকে আমরা পূণ্য অর্জণে ব্যর্থ না হই।
ফাইল ছবি: আলমগীর শিশির