বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন
অর্থনৈতিক ডেস্ক:: বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বেড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধির গতিটাই থেমে গেছে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে গত সাত মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২১ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩০১ কোটি (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন) ডলার। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারিতে সে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৩১ কোটি (প্রায় ৩২ বিলিয়ন) ডলার। যদিও গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে রিজার্ভ বাড়ার রেকর্ড গড়ছিল। কিন্তু নির্বাচনি বছরকে সামনে রেখে হঠাৎ বেড়ে গেছে আমদানির পরিমাণ। এতে সার্বিকভাবে চাপ বেড়েছে রিজার্ভে।
অবশ্য অচিরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও বাড়তে শুরু করবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান। তিনি বলেন, আমদানির চাপ থাকলেও সম্প্রতি রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধিও ভালো। ফলে খুব শিগগিরই রিজার্ভ আবারও রেকর্ড পরিমাণ বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ মোট দুই হাজার ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। যদিও এই সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে এক হাজার ৪৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এই হিসাবে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার−যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জুলাই-নভেম্বর এই পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ফলে রিজার্ভ থেকে আমদানি ব্যয় মেটাতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) খাদ্য (চাল ও গম) আমদানি বেড়েছে ২৫৭ শতাংশ। শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে ৪০ শতাংশ। জ্বালানি তেলের আমদানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে রিজার্ভে চাপ থাকলেও ভয়ের কোনও কারণ নেই। সরকারি বড় বড় প্রকল্প যেমন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় জিসিনপত্র আমদানি করতে হচ্ছে।
এদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মানও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, বিদায়ী বছরের জানুয়ারিতে প্রতি ডলারের জন্য যেখানে ব্যয় করতে হয়েছে ৭৮ টাকা ৭০ পয়সা, সেখানে বছরের শেষ দিনে অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বরে আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ৮৩ টাকা ২০ পয়সা।
এদিকে আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৩ কোটি ২০ লাখ (৪.৪৩ বিলিয়ন) ডলারে−যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি।
এশিয়া ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেশগুলো বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত থেকে পেঁয়াজ ও চাল আমদানি বেড়ে যাওয়ায় আমদানির পরিমাণ ব্যয় বেড়ে গেছে। সর্বশেষ আকুর দায় পরিশোধের পর আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন হাজার ২০০ কোটি ডলারে (৩২ বিলিয়ন) নেমে এসেছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ে সৃষ্ট এ দায় টাকার অঙ্কে ১১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। মার্কিন ডলারের হিসাবে এ দায়ের পরিমাণ প্রায় ১৩৬ কোটি ডলার, এটি এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ দেনা।
অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মান অনুযায়ী, যে কোনও দেশে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ থাকলেই তাকে নিরাপদ মাত্রা ধরা হয়। বাংলাদেশে বছরে গড়ে আমদানি ব্যয় হয় ৩৫০ কোটি ডলার। এ হিসাবে বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে ৯ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। কিন্তু তবুও গত আমদানির চাপ সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল করার দায়ে গত বছরে শেষ সময়ে ২৬ ব্যাংককে শোকজ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ২৯৯ কোটি (প্রায় ২২ বিলিয়ন) ডলার। এর দেড় মাস পর ১৮ মে এটি বেড়ে হয় ২ হাজার ৩৬০ কোটি (প্রায় ২৩ বিলিয়ন) ডলার। এর দেড় মাস পর ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০২ কোটি (প্রায় ২৫ বিলিয়ন) ডলার। এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৬ সালের ৩০ জুন রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৩ কোটি (প্রায় ৩০ বিলিয়ন) ডলার। একইভাবে ২০১৭ সালের ৩১ মে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩ হাজার ২২৪ কোটি (প্রায় ৩২ বিলিয়ন)ডলার। গত বছরের ২১ জুন রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩০১ কোটি (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে,২০১৭ সালের জুনের পর থেকে রিজার্ভ আর বাড়েনি। ৩১ অক্টোবর, ২ নভেম্বর ও ২৮ ডিসেম্বর ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ফিরলেও এখনও ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ঢুকতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।