বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৬ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বিলম্বিত করায় বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের একটি প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও।
মঙ্গলবার সিনেট প্রতিনিধি দলের সামনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদীয় অনুসন্ধান দল। তারা গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের পর এই প্রস্তাব পেশ করলেন। সে সময় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে দুই দেশের চুক্তিটি বিষয়েও কথা বলেন তারা।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম ২৩ জানুয়ারি শুরুর কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনেকগুলো পূর্বশর্ত পূরণের বিষয় আছে। কারণ, আমরা মিয়ানমারকে বলেছি- রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য এটি করতে গেলে অনেক কিছু করণীয় আছে। সেগুলো মিয়ানমারে যেমন, তেমনি আমাদেরও প্রয়োজন আছে। সে হিসেবে আমরা আমাদের অংশের কাজ করছি। আশা করি, মিয়ানমার তাদের অংশ করবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও রাজ্যের ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর জেফ মের্কলেইর নেতৃত্বে একটি সংসদীয় অনুসন্ধান দল গত নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করে। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন টড ইউয়াঙ্গ, টিম কাইন ও জন ম্যাককেইন। তারা চারজন মিলে সিনেটর প্রতিনিধিদের সামনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রস্তাবটি করেন।
জেফ মের্কলেই বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলো ভয়ঙ্কর। তা আগামী প্রজন্মের বিষয়ে আমাদের চিন্তিত করে তোলে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরগুলোত আমি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বিরুদ্ধে কৌশলগত ধর্ষণ ও হত্যার কথা বর্ণনা শুনেছি। আমি পুড়ে যাওয়া নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘরে আগুন দেওয়ার পর তারা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন।’
প্রস্তাব উপস্থাপনের সময় বেশ কয়েকজন সিনেটর উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, ড্যানিয়েল ফেইনস্টেইন, থম টিলিস, ডিক ডুরবিন, মার্কো রুবিও, ক্রিস ভ্যান হোলেন, রন ওয়েডেন, অ্যাডওয়ার্ড জে মার্কেই, এলিজাবেথ ওয়ারেন, শেরোর্ড ব্রাউন, টিনা স্মিথ ও ক্রিস কুনস।
মার্কিন সিনেটর মের্কলেই আরও বলেন, ‘সেখানে আমি শিশুদের আঁকা ছবি দেখেছি যাতে তারা নির্দোষ গ্রামবাসীকে সেনাবাহিনী গুলি করছে বলে দেখিয়েছে। এমন সহিংস জাতিগত নিধন অভিযানের পর আমাদেরকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের স্বতঃস্ফূর্ত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে।’
জন ম্যাককেইন বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কৌশলগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে যা বিস্ময়কর। তিনি আরও বলেন, গত আগস্ট মাস থেকে সাড়ে ৬ লাখের বেশি নারী, পুরুষ ও শিশুকে অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। জাতিসংঘ একে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ হিসেব বর্ণনা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের সশস্ত্র সেবা কমিটির চেয়ারম্যান ম্যাককেইন আরও বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক রোহিঙ্গা মনে করে ফিরে গেলে তাদের আরও বেশি সহিংসতার শিকার হতে হবে। বিতাড়িত পরিবারগুলোর ফিরে যাওয়া নিরাপদ, স্বতঃস্ফূর্ত ও মর্যাদাপূর্ণ হবে এমন নিশ্চয়তা থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ দাবিতে ছাড় দেওয়া উচিত হবে না।’
সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য সিনেটর টড ইউয়াঙ্গ বলেন, ‘রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই কৌশলগত ও শোচনীয় সহিংসতার কারণে লাখ লাখ মানুষ বিতাড়িত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন স্বতঃস্ফূর্ত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ করে তুলতে আমি সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে চাই।’
অনুসন্ধান দলের আরেক সদস্য সিনেটর টিম কাইন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত নির্যাতন ও ভয়ঙ্কর জাতিগত নিধন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অত্যাচারীদের বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত আমরা দাবি ত্যাগ করবো না।’
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সিনেটর ও ডেমোক্র্যাট দলের নেতা অ্যাডওয়ার্ড জে মার্কেই বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বিলম্ব করে বাংলাদেশ সঠিক কাজ করেছে।’ মিয়ানমারের জাতিগত নিধনের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন কখনই সঠিক পদক্ষেপ ছিল না। নিজেদের পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের অবশ্যই নিরাপদ বোধ করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও প্রত্যাবাসন স্থগিত করাকে স্বাগত জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিথার ন্যুয়ার্ট সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি আপনারা যে চুক্তির কথা বলছেন তা বিলম্বিত হয়েছে। আমরা নিশ্চিতভাবে একে ভাল ধারণা বলে মনে করছি। রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা শুধু নিরাপদ হলেই চলবে না, এটা স্বতঃস্ফূতও হতে হবে। আর এটা মর্যাদার সঙ্গে করতে হবে। তারা নিরাপদ বোধ না করলে দেশে ফিরতে তাদের ওপর জোর করা যাবে না।